বাংলার গ্রামীণ জগতের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা

লোকালয়ের ধারণা (indigenous knowledge) , কিংবা ঐতিহ্যগত ধারণা এমন এক ধরনের দেশীও জ্ঞান যা অঞ্চল বেঁধে বিভিন্ন উপায়ে চর্চা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিশেষ কোন অঞ্চলে কিছু কিছু ঐতিহ্যগত ধারণা বংশ পরাম্পরায় চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে। আচ্ছা হয়ত বুঝাতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছি। উদাহরণে আসা যাক! যেমন ধরুন খনার বচন, পল্লী গান, ছড়া, শ্লোক ইত্যাদি! তবে আজকে গল্প হবে, কেন এই ঐতিহ্যগত ধারণা গুলি টিকে আছে, বা এই কথাগুলোর ভূমিকা কি জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে কিংবা যেই পরিবেশে জীবের বসবাস তার মনুষ্য সৃষ্ট দূষণ রোধে!

ancient 2179091 960 720

মাটির পাতিল

মাটির পাতিল আমরা সবাই মোটামুটি দেখেছি। এই মাটির তৈরি থালাবাসন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যদিও তা এখন ইতিহাস হয়ে গেছে আধুনিক ভোগের চর্চার খাতিরে। তবে এই চর্চা ভূমিকা রাখে জীব বৈচিত্র্য রক্ষায়। মাটির থালাবাসন তৈরি করতে যান্ত্রিক দূষণ নেই বললেই চলে। শুধু কুমারের খাটুনি আর মাটির উপর ঝর তুফান। এই বার আসি ব্যাবহার করার পরবর্তী অবস্থায়। মাটির তৈরি এই জিনিস তেমন কোন ক্ষতির কারণই নয় যেমনটা ঘটে প্লাস্টিক জাতিও পণ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে।

water hyacinth 1547721 960 720

কচুরিপানা

কেমিক্যাল ব্যাবহার পরিবেশের জোন ক্ষতিকর। তবে পাঁই পরিস্কার করাও তো জরুরী। এমন কোন উপায় থাকলে তো ভালোই হতো যাতে পরিবেশেরও কিছু না হয় আবার পানিও পরিষ্কার থাকে। হ্যাঁ, এটির সমাধান হচ্ছে কচুরিপানা। কচুরিপানা দিয়ে পানি পরিষ্কার আরেকটি গ্রাম্য চর্চা যেখানে রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যাবহার ছাড়াই পানি পরিষ্কার আর ঠাণ্ডা রাখা হয়। মাছের খাদ্য, জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা আছে এই চর্চার।

খনার বচন, শ্লোক, ছড়া

“ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র বর্ষা হবে যেন”

frog 5319326 960 720

শুনতে ভালো লাগলেও, এই ভাবেই বর্ষা আসার আগাম বার্তা পেত গ্রামীণ জীবনের মানুষগুলি। যদিও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে এর পিছনে।অন্যান্য সরীসৃপদের মতো ব্যাঙের চামড়া জলরোধী না। তাই গরমকালে তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। এমনকি কিছু কিছু ব্যাঙ কয়েক ফিট মাটির নিচে নিজেদের আত্মগোপন করে রাখে যাতে ঠাণ্ডা পরিবেশ পাওয়া যায়। আর বিশুষ্কীকরণ এর ভয় এড়িয়ে, বেরিয়ে পরে বর্ষার সময়। আর তখনই গ্রাম্য সাধারণ মানুষগুলি মনে করে আকাশ থেকে ব্যাঙ আসছে আর বৃষ্টি হবে। বর্ষা খুব কাছে! এভাবেই এই ধারণা নিয়ে কৃষিকাজ চলে। রোপণ করা হয় ধান।

radishes 4266807 960 720

“ষোল চাষে মূলা,
তার অর্ধেক তুলা;
তার অর্ধেক ধান,
বিনা চাষে পান।”

এই খনার বচনটি চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে আলোকপাত করেছে। কোন চাষি যদি জমিতে ১৬ দিন চাষ করে তাহলে সেই জমিতে মূলার ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। আর তুলার ভালো ফলন পেতে চাইলে দরকার ৮ দিন, আর চারদিনেই যথেষ্ট ধানের ভালো ফলন। আর পান চাষের জন্য দরকার নেই কোন চাষাবাদের।

inflorescences 64407 960 720

“কলা রুয়ে না কেটো পাত,

তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত”

কলাগাছের ফলন হওয়ার পর কেউ যদি গোরা রেখে গাছটির উপরের অংশ কেটে ফেলে তাহলে নিচ থেকে আবার গাছের জন্ম নেয়। সেই গ্রামীণ জনগণকে খনা পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে তারা গোরা না কাটে। কলার ফলন দিয়ে তাদের জীবিকা চলে যাবে।

যদি বর্ষে আগুনে,

রাজা যায় মাগনে।

অগ্রাহয়ন মাসে বৃষ্টিপাতে অর্থনৈতিক দুর্দশা নেমে আসার সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন খনা। অগ্রাহয়ন মাসে বৃষ্টিপাতে অর্থনৈতিক দুর্দশা নেমে আসার সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন খনা। এই মাসে বৃষ্টিপাত হলে আবাদি ফসলে ক্ষতির মুখ দেখার সম্ভাবনা আছে।

“কোল পাতলা ডাগর গুছি

লক্ষ্মী বলেন ঐখানে আছি”

এই খনার বচনটিতে কীভাবে চাষাবাদ করতে হয় তার নমুনা পাওয়া যায়। ধানের জালা ফাঁকা করে রোপণ করার কথা বলা হয়েছে। এতে ভালো ফলনের সম্ভাবনা থাকে।

sunset 3875895 960 720

সরিষা বনে কলাই মুগ

বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক”

খনার কৃষকদের পরামর্শক ছিলেন বুঝাই যাচ্ছে। সরিষা ও মুগ বা সরিষা ও কলাই এক সাথে চাষ করার পরামর্শ দিয়েছিলো খনা। এতে চাষাবাদে ভালো ফলন আসে।

আউশের ভুঁঁই বেলে, পাটের ভুঁই আঁটালে

আউশ ধান বেলে মাটিতে ভালো হয় আর অন্যদিকে পাট ভাল হয় এঁটেল মাটিতে।

এই রকম আরও অনেক খনার বচন আছে যা কৃষকদের মুখে ছড়া আকারে থাকতো এবং কৃষিকাজে কিংবা আবহাওয়ার গতি বিশ্লেষণেও কাজ করতো এই খনার বচনগুলি।

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাতে যেমন করে সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছে ঠিক তেমন করেই গ্রামীণ ঐতিহ্য, ধ্যান ধারণাগুলো হারাতে বসেছে। যদিও বাস্তবতার নিরিখে বললে এটিই হওয়া স্বাভাবিক ছিলো। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো আস্তে আস্তে দূরে ঠেলে দেয়ার পিছনে কারন সহজবোধ্যতা। ভারী যন্ত্রপাতি আর আধুনিক প্রযুক্তির কলাকৌশলে খনার বচন কিংবা প্রচলিত ধারণাগুলির টিকে থাকা সত্যিকার অর্থেই দুষ্কর যদিও এই ধারনাগুলি মানুষের অনুকূলের পরিবেশ রক্ষার্থে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। তবে আমাদের দেশের সাহিত্যিক, গবেষকদের সাহায্য দরকার। তারা এই ধারনাগুলি যাতে বইয়ের পাতায় থাকে সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে। কারন অতীতের ঐতিহ্য স্মরণ করে সামনের এগিয়ে যাওয়াটাই হয়তো শ্রেয়।

Leave a Reply