পশ্চিমা বিশ্বের ৫ টি বড় দুর্নীতি

দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকাতে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের সারিতে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত বৈশ্বিক প্রকাশ ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ এ বাংলাদেশের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ২৬ যা খুব সন্তোষজনক পরিসংখ্যান নয়।

প্রথম বিশ্বের দুর্নীতি কোন পর্যায়ের হয় বা তারা কি আসলেই কতটা নিষ্ঠাবান তা সম্পর্কে ধারণা পেলে খারাপ হতো না। তবে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিকতা প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে, তৃতীয় বিশ্বের একজন নাগরিকের পজিটিভ মন্তব্য আসার সম্ভাবনাই হয়তো বেশি হবে। তবে শস্যের মধ্যেও যে ভূত থাকে! তাই আজকের আলোচনা হবে শস্যের ভূত নিয়ে।

সিমেন্স দুর্নীতি 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দেশ জার্মানি আর সেই দেশের কোম্পানি সিমেন্স দ্বারা হয়েছিলো ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত দুর্নীতি। সিমেন্স কোম্পানির দুর্নীতির মামলাটি ছিলো ইতিহাসের অন্যতম বড় দুর্নীতির মামলা।

ধারণা করা হয়, দুর্নীতি প্রকাশের পূর্বে সিমেন্সের দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমগুলি নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ ছিলো। দুর্নীতির কেলেঙ্কারী ছড়িয়ে পরার আগ পর্যন্ত সিমেন্সের সুনাম ছিলো বিশ্ব দরবারে। প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে খ্যাতির উচ্চস্তরেই ছিলো এই কোম্পানিটি। সিমেন্স প্রযুক্তিগত পণ্য থেকে শুরু করে টেলিকমইউনিকেশন সার্ভিস, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছিলো সুনামের সাথে।

মজার ব্যাপার হয়েছিলো সিমেন্সকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের কর্পোরেট সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত করা হয়। সেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যাদের জন্মই হয়েছে দুর্নীতি বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য।
সিমেন্স বিভিন্ন দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে আসছিলো। সিমেন্স এবং ওই সকল দেশের সরকারি কর্মকর্তারা অবৈধ সুবিধা আদান প্রদান করার ফলে সাধারন জনগণ অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে সেবা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।

ব্লুমবার্গ রিপোর্ট অনুসারে, জার্মানি তে ছিলো আরেক ট্যাক্স সুবিধা যেখানে বিদেশের মাটিতে করা দুর্নীতিকে ট্যাক্স মৌকুফ হিসেবে চর্চা করা হতো। দুর্নীতিগ্রস্থ কোম্পানি তখন তাদের আর্থিক বিবৃতিতে এই দুর্নীতিকে প্রয়োজনীয় ব্যয় হিসেবে দেখাতো।

তবে কেলেঙ্কারী প্রকাশিত ঠিকই হয়েছিলো ২০০৬ এর দিকে। বছরের পর বছর দুর্নীতি করে আসা সিমেন্স বিদেশি সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছিলো প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারী

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় প্রায়ই পত্রিকা, ব্লগ, টেলিভিশন থেকে শুনা যেতো পদত্যাগ দাবীর কিংবা ইম্পিচমেন্টের গুঞ্জন। তবে রিচার্ড এম. নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারীর কারনে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি। ১৯৭২ সালের ১৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রশাসনের পাঁচ জন ব্যক্তি আড়িপাতার যন্ত্র বসানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে সিকিউরিটি প্রটোকল ভেঙ্গে প্রবেশ করেছিলো ডেমোক্র্যাট দলের সদর দফতরে যার অবস্থান ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটার গেইটে।
তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকশন ক্যাম্পেইন চলছিলো। এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরে তেতাল্লিশ জন দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে যায়। আর নিক্সন হারায় ক্ষমতা। তবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জ্যারাল্ড ফোর্ড থাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

479886227 6ca1d54e9c

Attribution: “Public Domain: President Nixon Candid Photographs by Oliver F. Atkins, 1972 (NARA)” by pingnews.com is marked with CC PDM 1.0

এনরন কেলেঙ্কারি

আর্থিক সাফল্যের চুড়ায় থাকা একটি কোম্পানি কীভাবে রাতারাতি ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে তার এক বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে এনরন কর্পোরেশন। আচ্ছা, আগে এনরন সম্পর্কে হালকা ধারণা নেয়া যাক। এনরনের উত্থান হয় মার্জারের মাধ্যমে। মার্জার হচ্ছে একটি চুক্তি যেখানে দুটি বিদ্যমান কোম্পানি এক হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করে।

১৯৮৫ সালে কেনিথ লি হিউস্টন ন্যাচারাল গ্যাস এবং ইন্টারনর্থ কোম্পানিকে মার্জার করে এনরন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৫ সালের মধ্যে এনরন সুপরিচিত হয়েছিলো আমেরিকার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবনী কোম্পানি হিসেবে।

১৯৯৮ সালে এন্ড্রু ফাস্টওকে প্রমোশন দিয়ে বানানো হয় সি.এফ.ও যার কাজ আর্থিক বিষয়ের তদারকি করা। এন্ড্রু ফাস্টও এনরনের লোকসান গোপন করতে তৈরি করে অনেকগুলো কোম্পানির নেটওয়ার্ক।

২০০০ সালে এনরনের শেয়ার আকাশচুম্বী হয় যার মূল্য ছিলো ৯০.৫৬ ডলার। আর ২০০১ সালেই ধপাশ করে নেমে যায় এই মূল্য। বিশাল লোকসানে পরে এনরন কর্পোরেশন। এনরন তাদের আর্থিক বিবরণীতে দেখায় ৬১৮ মিলিয়ন ইউ এস ডলারের লোকসান। ২০০১ সালের ভিতরেই শেয়ারের মূল্য আরও কমতে থাকে। অক্টোবর ২২ এর দিকে কমে যা দাড়ায় ২০.৭৫ ডলার। নভেম্বরে এসে স্বীকারোক্তি দেয় যে তারা ১৯৯৭ সাল থেকে বাড়িয়ে আসছিলো তাদের ৫৮৬ মিলিয়ন ইউ এস ডলারের আয় যেখানে বিনিয়োগকারীর ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে এনরনে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক হিসাব বিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড গ্যাপের (GAAP) সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক তথ্যের গোঁজামিল দিয়ে বাড়ানো হয়েছিলো আর্থিক মুনাফা। প্রতারণার স্বীকার হয় বিনিয়োগকারীরা। এই দুর্নীতির ফলে এনরনের সমাপ্তি হয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরের দিকে যখন তাদের শেয়ার মূল্য ০.২৬ ডলারে নেমে যায়। আর দেউলিয়া ঘোষিত হয় এনরন কর্পোরেশন।

এই দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলো আর্থার এন্ডারসন এল.এল.পি। আর্থার এন্ডারসন এল.এল.পি কে বিগ ফাইভ ও বলা হতো। এই ফার্ম ওই সময়ের সবচেয়ে বড় একাউন্টিং ফার্ম গুলির একটি ছিলো। আর্থার এন্ডারসনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় অডিট সম্পর্কিত ডকুমেন্ট ধ্বংস করে ফেলবার জন্য। অবশেষে এই এনরন কেসই ধ্বংস করে আর্থার এন্ডারসন এল.এল.পি এর মতো বড় ফার্ম কে।

ডান্সকে ব্যাংক 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে ডেনমার্ক হচ্ছে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ গুলির একটি। তবে বলা হচ্ছে, এই দেশেই ইউরোপীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানি লন্ডারিং এর কেস সংগঠিত হয়েছিলো। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ব্যাংক ডান্সকের যোগসূত্র আছে এই বেআইনি লেনদেনে দাবী করা হয়েছিলো কিছু আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে।

২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এস্তনিয়ান শাখায় প্রশ্নবিদ্ধ ২০০ বিলিয়ন ইউরো প্রবাহিত হওয়ার ঘটনার স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর ডান্সকে ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক থমাস বরগেন পদত্যাগ করেছিলেন।

ডিজেলগেট কেলেঙ্কারি

ভক্সওয়াগেন কোম্পানির নাম আমরা অনেকেই শুনে থাকবো হয়তো। জার্মান গাড়ি কোম্পানি আমাদের দুর্নীতির আলোচনায় আসলো কি করে! হ্যাঁ, ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র উদঘাটন করেছিলো ভক্সওয়াগেনর ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজেল নির্গমন টেস্টে কারসাজি করার ঘটনা।

ভক্সওয়াগেন গাড়িগুলোর মধ্যে বেআইনি সফটওয়্যার ব্যাবহার করে টেস্টে প্রকৃত ফলাফলের পরিবর্তন করতো। ডিভাইস ব্যাবহার ছাড়া মানে প্রকৃত অর্থে ৪০ ভাগ দূষণ বেশী আসতো গাড়ি থেকে।
জনগণের স্বাস্থ্য বিপর্যয়য়ের মুখে ফেলে দিয়ে অর্থ কামিয়ে নিয়েছিলো ভক্সওয়াগেন।

Protest vor dem Dieselgate-Untersuchungsausschuss in Berlin, 8.3.2017

চিত্রঃ প্রতিবাদ করছেন, attribution: “Protest vor dem Dieselgate-Untersuchungsausschuss in Berlin, 8.3.2017” by BUND Bundesverband is licensed under CC BY 2.0

আরও অনেক দুর্নীতির ঘটনা আছে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে। যেমন পর্তুগালের ট্যাক্স সংক্রান্ত দুর্নীতি এবং বিশেষ করে, এলিজাবেথ হোমস এর উপর আসা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে হয়েছিলো আলোড়ন। তবে একটি জিনিস দেখা যায় যে দুর্নীতি করে খুব দ্রুত আর্থিক সাফল্যের লোভ এনে দিতে পারে কঠিন বিপর্যয়।
এনরন কেলেঙ্কারিতে ধ্বংস হয়েছিলো এনরন কর্পোরেশন, সেই সাথে বিখ্যাত একাউন্টিং ফার্ম আর্থার এন্ডারসন এল.এল.পি। জেলে যেতে হয়েছিলো এক সময়ের বিত্তবানদের। আবার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন নিক্সিন।

এই দুর্নীতি কেড়ে নিয়েছিলো সম্মান, অর্থ, সব কিছু। তবে এমন অনেক ঘটনাও রয়েছে যেখানে দুর্নীতিবাজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অন্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে যা সে নিজেও ঠিকভাবে ভোগ করতে পারবে না।

মানুষ সত্যিই অদ্ভুদ! সেই সিমেন্স দুর্নীতি থেকে শুরু করে এনরনের মতো বড় বড় কেলেঙ্কারী দ্বারা একটি জিনিস প্রকাশ পায় কতটা কঠোর নিয়ম হওয়ার পরেও মানুষ দুর্নীতি করতে প্রণোদিত হয়।

তবে এই দুর্নীতি তো তাদের অন্তর্গত দুর্নীতি। বছরের পর বছর করে আসা ইউরোপর রাষ্ট্রীয় পরিসরের দুর্নীতি তো ছিলো বিস্ময়কর। আফ্রিকার আর আমাদের উপমহাদেশের সম্পদ লুট করে ইউরোপে নিজেদের সম্পদের পাহাড় বানানোতে নিজেদের মধ্যে ছিলো প্রতিযোগিতা। ফ্রান্স, স্পেইন, ইতালি, জার্মানি, হল্যান্ড, পর্তুগালের উপনিবেশ এবং তাদের লুটতরাজ বাদ গিয়েছে আলোচনা থেকে। সেটি নিয়ে অন্য কোন দিন হবে আলোচনা।

আরও পড়ুন…

https://bicchuron.com/2657/%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%9f-%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a4/

 

 

তথ্য উৎসঃ

 

 

 

Leave a Reply