অযোগ্যরা কেন নেতা হচ্ছে?
আপনি কি এমন কাউকে দেখেছেন যে নিজেকে যত বড় ও যোগ্য মনে করে, যদি তত বড় সে নয় কিংবা তার যোগ্যতাও তত বেশি নয় ? এসব মানূষদের বেশিরভাগই সাধারণত হয় পুরুষ। এর কারন হলো, নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নারীদের থেকে পুরুষরাই বেশি মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই ধরনের মানূষদের নিজেদের ক্যারিয়ারে সফল হবার সম্ভাবনাও বেশি!
অন্যদেরকে বোকা বানিয়ে নিজে সফল হবার প্রথম শর্তই হচ্ছে আগে নিজেকে নিজের কাছে বড় বলে ধোকা দেয়া এবং নিজের বলা মিথ্যাগুলোতে নিজেই আগে বিশ্বাস করা। আর এই কারনেই এধরনের মানূষ যারা নিজেকে অন্যদের থেকে বড় মনে করে আপনি শুধু তাদের সাথেই কাজ করেননি বরং তাদের অধীনে কাজ করেছেন।
দুঃখজনকভাবে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে অনবগত থাকা আপনার বস হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
সাইকোলজিস্ট এবং গবেষক যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের আচার-আচরণের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে, তাদেরকে লিঙ্গ, ব্যক্তিত্ত এবং নেতৃত্তের আন্তঃ সম্পর্ক গুলো সব সময়ই অবাক করে, বিশেষ করে কিভাবে লিঙ্গ এবং ব্যক্তিত্ত আমাদের নেতা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রন করে এবং এই এরপর এই নির্বাচিত নেতারা কিভাবে তাদের অধিনস্ত সংগঠনের উপর প্রভাব ফেলে।
লিঙ্গ নিয়ে আলোচনা সাধারনত নারী নেতৃত্তকে ছোট করে দেখার উপর কেদ্র করে হয়ে থাকে যা মূলত পৃথিবীর সকল দেশেই কম-বেশি রয়েছে। আইসল্যান্ডের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের নেতারা সাধারণত পুরুষ হয়ে থাকে। তার চেয়েও বড় কথা হল এই নেতাগুলোর বেশীরভাগই নেতৃত্তদানে অত্যন্ত অযোগ্য।
ব্যবসা বা রাজনীতিতে বেশিরভাগ নেতাদেরই তাদের অধীনস্থদের প্রতি অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব কাজ করে, পরিনামে অধিনস্তদের অংশগ্রহনের আগ্রহ কমে যায়, বিশ্বাস থাকেনা এবং একই সাথে উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয় এবং কর্মীরা মানসিক চাপে ভুগে থাকেন।
বেশিরভাগ মানুষই তার ম্যানেজার কিংবা বসের প্রতি নেতিবাচক ধারনা পোষন করে থাকেন। এখন প্রশ্ন হলো নেতৃত্ব দানের স্থান গুলোতে কেন আর ও নারী নেই কিংবা কেন এত অযোগ্যরা বসে আছে ?
এর কারণ মূলত তিনটি।
প্রথম কারণ হচ্ছে, যারা নেতৃত্ব নির্বাচন করেন, বা আমাদের ক্ষেত্রে, আত্মবিশ্বাস এবং যোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা। আমরা প্রায়শই ভেবে থাকি কেউ যদি আত্মবিশ্বাসী হয় তার পক্ষে নেত্রিত্তদানে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যে কোন খাতে, আপনি নিজেকে কত এক্সপার্ট মনে করেন তার সাথে আপনি আসলে কতটা এক্সপার্ট তার সম্পর্ক খুব কমই থাকে।
অর্থাৎ যে খাতের কথাই আপনি বলুন, আত্মবিশ্বাস, অর্থাৎ কেউ নিজেকে কোন কাজে কতটা ভাল ভাবে, তার সাথে আসলে, সে কতটুকু ভাল কাজ পারে, অর্থাৎ প্রকৃত যোগ্যতার আসলে কোন সম্পর্ক নেই, একটি হল মনের ধারণা, আরেকটি বাস্তবতা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতাস্থানে বসে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের যতটা যোগ্য মনে করেন, তাদের প্রকৃত যোগ্যতা রয়েছে আসলে সামান্যই।
দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্তের প্রতি আমাদের মোহ। যা মূলত ৬০ এর দশকের পর থেকে বিশেষ করে এখন, এই ডিজিটাল যুগে, দেখা যায় দেশের মানূষ এমন লীডার চায় যারা
অত্যন্ত আকর্ষণীয়, মোহনীয় এবং বিনোদনমূলক। কিন্তু একজন কার্যকরী লীডারের সাথে একজন সফল স্ট্যান্ড আপ কমিডীয়ানের বিশাল ফারাক রয়েছে। বেশিরভাগ কার্যকর এবং সেরা নেতারা আকর্ষণীয় হবার থেকে বরং বিনয়ী ছিলেন।
তাদের বিনয় টা এমনকি বলা যেতে পারে বোরিং পর্যায়ে ছিল। আর এই কারনে এসব নেতাদের কিন্তু মিডিয়াতে বা ব্লক বাস্টার মুভিতে দেখানো হয়না। কারন ক্যামেরায় দেখাতে হলে কার্যকরিতার প্রয়োজন হয়না বরং প্রয়োজন হয় আকর্ষণীয় এবং বিনোদনমূলক হবার ।
যেমন আঞ্জেলা মার্কেল একজন কার্যকর নেতা। এখন তার মত এক মহিলাকে কল্পনা করুন তো কোন মুভির প্রধান চরিত্র হিসেবে ! ভালো লাগার তো কথা নয়।
ভাবুন যে তিনি ঘুম থেকে উঠছেন, পরিবারের জন্য নাস্তা তৈরি করছেন, মিটিঙ এ যাচ্ছেন উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে, এবং দিনের কাজ গুলো অত্যন্ত সক্ষমতার সাথে কোন ড্রামা ছাড়াই শেষ করলেন।
যখন কেউ কথা বলে তখন তিনি চুপ করে শোনেন, কথা বলার সময় বাধা দেননা বা কোন রকম সিন তৈরি করেননা। সুন্দর ভাবে দেশ পরিচালনা করেন, তাকে নিয়ে কোন স্ক্যান্ডাল নেই। এরকম চরিত্র নিয়ে মুভি করা হলে তা কি কেউ দেখবে ? যেখানে কোন উথান পতন নেই, সুচারু ভাবে সব সম্পন্ন হচ্ছে ?
অন্য দিকে আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের প্রায়শই খারাপ কিছু দিক থাকে এবং তাদের অযোগ্যতার কারনে তারা তাদের দেশ, সংগঠন ধংসের দিকে নিয়ে যায়।
অবশেষে তৃতীয় কারন হচ্ছে, স্বার্থপর আত্মমুগ্ধ ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের অশেষ আকর্ষণ যার আমাদের নিজেদের আত্মমুগ্ধতায় কাজ করে। এই ধরনের অযোগ্য আত্মমুগ্ধ ব্যক্তিরা আমাদের অসম্ভব অর্জনের আশা দেখায় এবং তাদের অযৌক্তিক উচ্চাকাংখার সাথে আমাদের স্ব স্ব উচ্চাকাংখ্যা যুক্ত হয়।
আমরা সাধারণত বিখ্যাত ব্যক্তিদের পছন্দ করি, বিশেষ করা যারা শুধুমাত্র খ্যাতির কারণে বিখ্যাত। এরকম মানূষের সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে যাদের প্রকৃত পক্ষে দেশ বা জাতির উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখার সক্ষমতা না থাকা সত্তেও তারা বিখ্যাত, তাদের খ্যাতির পেছনে উপযুক্ত কারনও দর্শানো মুশকিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব সফল মানূষেরা বড় বড় উপদেশ দেয়, তারা মূলত স্বার্থপর মনোভাব বহন করে থাকে। যেমন ধরুন এরকম কথা আপনি হয়তো শূনে থাকবেন, যাই হোক নিজেকে ভালোবাসো, লাভ ইওর সেলফ! মানূষ কি ভাবে তোমাকে নিয়ে তা নিয়ে ভেবোনা। তুমি যদি নিজেকে সেরা ভাবো তাহলেই তুমি সেরা।
এই ধরনের আইডিওলোজি মুলত আরও কতগুলো নতুন এমন ধরনের নেতৃত্ত তৈরি করে, যারা নিজেকে নিয়ে সন্তুস্ট থাকে এবং স্ব স্ব সীমাবদ্ধতা নিয়ে যাদের কোন ধারণা নেই, নিজেদের কর্মক্ষমতার শিখর সম্পরকেও তাদের কোন জ্ঞ্যান থাকেনা।
এবং তারা দেশের যে অবস্থাই করুক নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকে। এই ধরনের মানূষেরা মূলত নেতৃত্তকে তাদের নিজেদের পাওনা মনে করে, সহানুভূতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রনে অক্ষম। পরিনামে তারা ন্যয়পরায়ন ভাবে সংগঠন চালাতে ব্যর্থ হয় এবং অযৌক্তিত ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতিকে বিপদে ফেলে।
এর বিপরীতে সেরা সেরা লিডারেরা তাদের এই নিজেদের স্বার্থপরতা নিয়ন্ত্রনে রেখেছেন, এবং তারা অন্যদের ব্যপারে ভাবেন, অন্যরা তার ব্যপারে কি ভাবে সেটার গুরুত্ত দেন, কলুসতা মুক্ত থাকার চেস্টা করেন। তারা নিজেদের রেপুটেশনকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখেন ফলে তাদের নিয়ে স্ক্যান্ডালের ঘটনা খুবই বিরল থাকে।
এখন আসল কথা হলে আমরা কিভাবে অযোগ্য মানূষদের নেতা হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারি ? প্রথমত যোগ্য নেতার লক্ষণগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। নেতার মধ্যে যে গুন গুলো মোহনীয় ও আকর্ষণীয় এবং যে গুণগূলো প্রয়োজন এই দূটোর ক্ষেত্রে প্রকাণ্ড অসামঞ্জস্য রয়েছে।
আমরা যদি দেশ চালনায় সক্ষম নেতা কামনা করি তাহলে উপযুক্ত গুনাগুনের দিকে নজর দিতে হবে।
মোহনিয়, আকর্ষণীয় চরিত্রের প্রতি না প্রলুব্ধ হয়ে তাদেরকে নেতৃত্তে জায়গা দিতে হবে যাদের যোগ্যতা রয়েছে, রয়েছে মানবতাবোধ এবং বিনয়।
যোগ্য লীডার বাছাই শুরু হলে দেখবেন পুরুষের থেকে নারী লীডারই বেশি আসবে কারণ, এটি অনেক বছর ধরে চলে আসা বৈজ্ঞানিক গবেষনায় প্রমানিত যে নারীরা পুরুষের থেকে বিনয়, মানবতাবোধ এবং যোগ্যতার দিক থেকে এগিয়ে।
মূল কথা হল যে এভাবে দেশ ও সংগঠনের জন্য যোগ্য নেতৃত্ত পাওয়া সম্ভব হবে।