চিঠি

চিঠি

২০১৮’র জানুয়ারী প্রায় শেষর দিকে। গত ডিসেম্বরই বিবিএ’র শেষ সেমিস্টারের রেসাল্ট পেয়ে মোটামুটি খুশি মুস্তাকিম। টেনে টুনে মোটামুটি মানসম্মত কিছু একটা দাঁড়িয়েছে সার্টিফিকেটর আয়নায়। জব খুঁজতে হবে যদিও বাজারের অবস্থা ভালো না।

তাকাতে তাকাতে প্রায় ২৩ দিন চলে গেছে বাসায় ঘুমিয়ে। এক বড় ভাই বলেছিল, ” মুস্তাকিম, গ্রাজুয়েশন শেষ করেই ঘুরতে বের হইছ, একবার চাকরিতে ঢুকলে আর রক্ষা নাই। সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ঘানি ভাঙবি, কিন্তু সরিষার তেল গায়ে লাগাইব তোর বস।” হঠাৎ বড় ভাইয়ের কথাটা মনে হতেই মন টা খারাপ হয়ে গেল মুস্তাকিমের। মুস্তাকিম মনে মনে উপহাস করে বলল, “আগে চাকুরী তো পাই! শালা, চাকুরী পাইয়া খালি জ্ঞান দেয়। যদিও কথাটা মন্দ কয় নাই । কোথাও ঘুরতে যাওয়ার দরকার।”

তখনই মুস্তাকিমের মা রুমের সামনে এসে বলল, ‘ কিরে, তুই আর কত ঘুমাইবি”

মুস্তাকিমঃ মা! আমি জাইগা আছি, এহন বাজে ৩ টা, আজকে তাড়াতাড়ি উঠছি!

মুস্তাকিমের মা বিরক্তের সহিত বললঃ হুম, তাড়াতাড়ি মানে ১২ টা। আর শুন, তোর নানা কল দিছে, দেশে পুকুর কাটে।
মুস্তাকিমঃ অ্যাঁ, নানা কি প্রত্নতাত্ত্বিক রিসার্চ শুরু করছে নাকি, ভালা জমিডিরে দিবো সমুদ্দর বানাইয়া। কই করতাছে?
মাঃ পশ্চিমধারের দিকে, তোরে যাইতে কইল!

মুস্তাকিমঃ আমারে দিয়া কি কাম, মাটি কাটাইব নাকি। নাহ যাইতে হইব তো

মাঃ হ, যা। খুশি হইব তোর নানা!

যথারীতি ২১ জানুয়ারির সকালে, নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো মুস্তাকিম। পৌঁছুতে মাত্র এক ঘণ্টা লাগলো। আর পৌঁছানো মাত্রই নানা-নানীর আদর শুরু। তবে নাস্তা করেই নানার সাথে সে গেল পুকুর কাটা দেখতে। যদিও দাড়িয়ে পুকুর কাটা দেখার মাঝে কোন মজা নাই, তাও ওখানেই পরে রইল মুস্তাকিম। হঠাৎ, চিৎকার।

শ্রমিকদের একজন এসে বলা শুরু করলো,” চাচা, ট্রাঙ্ক পাইছি একটা”

দৌড়ে গেলো সেখানে মুস্তাকিম। সবাই খুশি। অনায়াসে জরাজীর্ণ তালা খুলে আসলো। খোলা মাত্র সবাই হতাশ , খামে মোড়ানো চিঠি দেখে। খুব শক্তিশালী ট্রাঙ্ক মনে হয়েছিলো। চিঠি ছাড়া বাকি সব ভালো জিনিসই আশার তালিকায় ছিল। গুরুত্বহীন চিঠি টা নিয়ে বাসায় এসে পড়ল মুস্তাকিম। যাইহক কৌতূহলী মন নিয়ে পড়া শুরু করল মুস্তাকিম।

চিঠিতে……
“প্রিয় আগন্তুক,
আজ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। জানি না, কেন লিখছি। তবে এতুটুকু জানি, না লিখলে খারাপ লাগবে। আমার মনের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হয় যন্ত্রণার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পরেছি। এর পরেই তো সুখ। ভাবতে ভালোই লাগছে এখন। তবে আমার মতো কেউর কি ভালো লাগা উচিৎ। স্বজাতির কাছে যার স্ত্রী ধর্ষিত হয়, যার মা ভাই নিখোঁজ হয়, তার বেঁচে থেকে কি লাভ আছে? হ্যাঁ, আমি তো এখনও জীবিত, পশুদের সাথে যুদ্ধও করেও। কিছুক্ষণ আছি এখনও। তবে গতকালকে বাজারে দেখলাম আনন্দের মিছিল! সবাই খুশি সবকিছু হারানোর পরেও। মানুষ ভুলে যাবে অতীতের যন্ত্রণা। নতুন আসার আলোয় আবারও বাঁচতে শিখবে। তবে আমার যে সব আলো শেষ। আমি জানি কিছুই পরিবর্তন হবে নাহ। একদিন এই জাতীই হয়ত খুন করবে জয়ের নায়ককে। কে জানে? হতেই পারে! মানুষ ভয়ংকর নেকড়ে। হয়তো যারা এই যুদ্ধের বিপরীতে ছিল তারাই শাসন করবে। এমনও হতে পারে যারা আজ যারা স্বাধীন করেছে তারাই ডাকাতের মতো লুট করবে। কিসে তাহলে পার্থক্য। কেন এমন হয়, কেন এই যুদ্ধ? কেন মৃত্যু? বেঁচের থাকার মানেই কি লড়াই? অস্তিত্ব ভারী হয়ে গেছে। আমি ক্লান্ত।”

মুস্তাকিম হতম্ভব হয়ে কতক্ষণ দাড়িয়ে রইল… হতাশার পরিমানটা কোথায়ও যেন একটু বেড়ে গেলো।

 

 

Leave a Reply