নবী রাসুলের জীবনকাহিনী ( সৃষ্টি এবং আদম আঃ )

সৃষ্টি এবং নবী আদম আঃ

“কাহিনি গুলো তাদের শোনাও যেন তারা শিক্ষা গ্রহন করে” ,এই ছিল আল্লাহর আদেশ মোহাম্মদ (সঃ) এর উপর । এই কাহিনী গুলো আমাদের আনন্দ দেবার জন্য নয় । এই গল্প গুলো আমাদের জন্য যেন আমরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহন করে নিজেদের জীবনে তা প্রয়োগ করতে পারি , গভীরভাবে তা নিয়ে চিন্তা করতে পারি । এগুলো আল্লাহর শোনানো কাহিনী, যেন আমরা তা খুব গুরুত্ব সহকারে নিতে পারি ।

যাকে আমরা চিনিনা,জানিনা, তাকে ভালবাসা অসম্ভব ।

আমরা সবাই দাবী করি যে আমরা নবী-রাসুলদের ভালবাসি , কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমরা যদি না জানি, যদি না জানি তাদের কঠোর পরিশ্রমের জীবনগাথা ,তাহলে তাদের প্রতি ভালবাসা , শ্রদ্ধা কিভাবে আসবে ! মুসলিম হিসেবে এটা জানা আমাদের উপর খুবই জরুরী । তাদের বার্তা যা তারা নিয়ে এসেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, তা জানা ও অন্যদের কাছে পৌছে দেয়া ।

নবীদের সংখ্যা কত ? এক লক্ষ বিশ হাজার । তাদের মধ্যে সরাসরি বার্তাবাহক রাসুলের সংখ্যা তিনশ পনের জন ।

নবুয়তির শুরু হয়েছে এই পৃথিবীর প্রথম মানুষটি থেকে । প্রথম নবী , অ্যাডাম ,( আদম আঃ ),তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক, এরপর যত নবী-রাসুল এসেছেন সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে, তাদের সবাই এসেছেন তাদের স্বজাতির কাছে, সহজ ভাষায়, তাদের সকলের আহবান ছিল একই । মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে ডাকা,খারাপ থেকে ভালর দিকে আহবান করা ,ভাল কাজ করতে বলা । তাদেরকে যখন কোন জাতির কাছে পাঠানো হত,তাদের ভাষা হত ওই জাতির সময়ে, ওই জাতির পরিচিত ভাষায় , যেন আহবান বুঝতে কারো অসুবিধা না হয় । তারা আদেশ করতেন মানুষদের, এই বলে যে, হে আমার জাতি,তোমরা সর্বশক্তিমান কে মেনে চল, এবং শুধু তার’ই উপাসনা কর ,এবং ভাল কাজ কর ।

এ ছিল  আব্রাহাম এর বানী (ইব্রাহীম আঃ), এ ছিল নোয়াহ (নুহ আঃ) এর বানী, একই কথা বলেছেন মোসেস (মুসা আঃ), ডেভিড (দাউদ আঃ) ,সলোমন (সুলাইমান আঃ), জন দ্য ব্যাপটিস্ট (ইয়াহিয়া আঃ), জিসাস (ঈসা আঃ) এবং সর্বশেষে মোহাম্মেড (মুহাম্মদ সঃ) ,তাদের সবার উপর শান্তি বর্ষিত হোক ।

নবী রাসুলের জীবনকাহিনী ( সৃষ্টি এবং আদম আঃ )
সৃষ্টির শুরু

রসুলুল্লাহ সঃ বলেছেন  ‘শুরুতে ছিলেন আল্লাহ,তাঁর আগে কিছুই ছিলনা’ ,হাদিসের আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া গেছে যে, ‘তাঁর সঙ্গে কিছুই ছিলনা’,এবং তাঁর সিংহাসন ছিল পানির উপরে এবং তিনি সবকিছু লিপিবদ্ধ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন আকাশ ও পৃথিবী । সর্বপ্রথম তিনি যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন তা হল কলম । অতঃপর তিনি আদেশ করেন এটিকে লেখার জন্য ।

সুতরার এটি লিপিবদ্ধ করে ফেলে কেয়ামত পর্যন্ত যা হবে সবকিছু । আকাশ ও এই পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সবকছু লেখা হয়ে গেছে ,যা কিছু আমরা পাবো,যা কিছু হবে সবকিছুই লেখা হয়ে গেছে । আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে নয়, আকাশ ও জমিন সৃষ্টিরও পঞ্চাশ হাজার বছর আগে । প্রতিটা জিনিস,এমনকি যে নিঃশ্বাস আমরা প্রতি মুহূর্তে নিচ্ছি, অথবা যে পাতাটি গাছ থেকে এই মুহূর্তে ঝরে পড়লো ,এ সব কিছুই, প্রতিটা ঘটনা লেখা হয়ে আছে !

অতঃপর মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেন ফেরেশতাদের ,তিনি ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন আলো থেকে । তারা আল্লাহ্‌র দাস ,তাদের নিজস্ব কোন চাহিদা নেই । তারা কি করে ? তারা শুধু আল্লাহ্‌র ইবাদত করে, তারা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রার্থনা করতে থাকে , তারা কখনোই ক্লান্ত হয়না এবং তাদের সংখ্যা অগণিত । মুহাম্মদ সঃ যখন সপ্তম আকাশে গিয়েছিলেন, তিনি সেখানে সাক্ষাত করেছিলেন ইব্রাহীম আঃ এর সাথে । ইব্রাহীম আঃ সপ্তম আকাশের বায়তুল মা’মুর এ হেলান দিয়ে ছিলেন ।

বায়তুল মা’মুর হচ্ছে সপ্তম আকাশের একটি পবিত্র জায়গা, ঠিক যেমন কাবা এই  পৃথিবীর । রসুলুল্লাহ সঃ বলেন যে প্রতিদিন আল্লাহ সত্তর হাজার নতুন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন ,তারা এই বায়তুল মামুরের পাশ দিয়ে চলে যায়,আর কখনোও তারা এটার কাছে ফিরে আসেনা ।

মানুষ সৃষ্টির আগে আল্লাহ জিন সৃষ্টি করেছিলান । আদম আঃ আসার দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো এই জিনেরা । তিনি জিন সৃষ্টি করেছেন আগুনের শিখা থেকে । তারা ছিল প্রব্ল শক্তিধর , সংখ্যায় অগণিত, জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত । তাদের মধ্যেও মানুষের মত বিবাহের প্রচলন ছিল, ছিল বংশধর ।



কিন্তু তারা ছিল চরমভাবে পথভ্রষ্ট, তখন গোটা জিন গোষ্ঠীদের মধ্যে একমাত্র কর্তব্যপরায়ণ,ঈমানদার জিন’টির নাম ছিল ইবলিস । এবং তাঁর সৎ গুনাবলির পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে উথিত করেন্ । বাকি যারা ছিল তারা ছিল অতিশয় মন্দ, পৃথিবীর বুকে তারা নিজেদের মধে বিবাদে লিপ্ত থাকতো আর অবিরাম রক্তপাত ঘটাত ।

তাই মহান আল্লাহ পাঠালেন তাঁর ফেরেশতাদের, একই সাথে পাঠালেন ইবলিসকেও , ওই মন্দ জিন্ দের কে পৃথিবীর বুক থেকে উৎখাত করার জন্য । তখন তাদেরকে কোণঠাসা করে করে ফেলা হয়েছিল সাগরের মাঝে একটি দ্বীপে ।

আল্লাহ তা’আলা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন ছয় দিনে । নবী মুহাম্মদ সঃ আবু হোরায়রা’র হাতটী ধরে বললেন, ও আবু হোরায়রা, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন আত’তুরবাহ । আত’তুরবাহ হছে ধুলা,আল্লাহ তা সৃষ্টি করেছেন শনিবার ।

রবিবার তিনি সৃষ্টি করেছেন পর্বতমালা । সোমবার বৃক্ষরাজি । অতঃপর মঙ্গলবার তিনি সৃষ্টি করেন আল মাক’রুব, মাকরুব হচ্ছে অণুজীব, ক্ষুদ্র কণা সমূহ । বুধবার তিনি সৃষ্টি করেন আলো এবং বৃহস্পতিবার তিনি পৃথিবীর বুকে বিচরন করার জন্য ছড়িয়ে দেন সকল জীব-জন্তু ।

আদম আঃ

আল্লাহ বললেন ফেরেশতাদের , ‘আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি পাঠাব’ । ফেরেশতারা ভীত হয়ে পড়ল, তারা বলল, ‘ও আমাদের মালিক,আমাদের উপ্র কি আপনি অসন্তুষ্ট ? আমরা তো সর্বদাই আপনার ইবাদত করি’।

পারতপক্ষে তারা বুঝতে পারছিলনা কি ঘটছে ।

ফেরেশতাগণ আরও বলল ,কেন আপনি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন এক সৃষ্টি যারা পৃথিবীর বুকে হাঙ্গামা সৃষ্টি করবে ,একজন আরেকজন কে হত্যা করবে,এবং আপনার জন্য আছি আমরা । আমরা তারা, যারা সবসময় আপনার পবিত্রতা ঘোষনা করি , আপনার উপাসনা করি  ও আপনার আদেশ পালন করি ,এই সৃষ্টির কোন দরকারই তো নেই ও আল্লাহ !

মহান আল্লাহ বললেন, ‘আমি জানি যা তোমরা জাননা’ ।

ফেরেশতারা তখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করল, নিশ্চই আল্লাহ আমাদের থেকে জ্ঞানী বা সম্মানিত কাউকে সৃষ্টি করবেন না ।

রসুলুল্লাহ সঃ বলেন , ‘আল্লাহ আদম কে তৈরি করেন এক মুষ্টি মাটি দিয়ে’ ,এই মাটি নেয়া হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে ,এর কিছু অংশ ছিল পাহাড়ি মাটি,কিছু নেয়া হয়েছিল  উপত্যকা থেকে, কিছু অংশ নেয়া হয়েছে উর্বর জমি থেকে আর কিছু নেয়া হয়েছে অনুরবর শুস্ক মাটি থেকে । এবং এই সব একসাথে মিশান হয়েছিল । আর এ কারনে আদম আঃ এর বংশধররা ছিল বিভিন্ন বর্ণের ,ভিন্ন গুণাবলীর । তাঁর কিছু অংশ হল ন্যায়পরায়ণ, কিছু মন্দ, কেউ বলিষ্ঠ, কেউ বা আবার দুর্বল । আল্লাহ এই মাটিকে বলেছেন ধুলা,ময়লা,কাদা,ঠনঠনে শুস্ক মাটি,কালো মসৃণ মাটি ,এই মিস্র মাটিকে পানি মিশনো হয়েছিল যা ছিল সকল জীবনের উৎস,আর এই কাদামাটি কিছুদিন ফেলে রাখার পর তাতে আদ্রতার পরিমাণ কমে গিয়ে তা আঠাল, মসৃণ মাটিতে পরিনত হয় এবং এটি কালোবর্ণ ধারণ করে ।

আর এটি দিয়ে আল্লাহপাক আদম আঃ এর শরীর তৈরি করেন এবং তা ফেলে রাখা হয়েছিল বহুদিন । ফেরেশতাগন এসে ভিড় জমাত আল্লাহ্‌র এই বিশাল, অপূর্ব সৃষ্টি দেখার জন্য । সময়ে সময়ে তারা এই সৃষ্টি দেখে ভিত হয়ে পড়ত । সবার মুখে তখন একই কথা, আদম কে নিয়ে ।

আর ইবলিস তখন ভাবতে শুরু করলো , এই জীবটির বিশেষত্বটা কি ? কেন এটি আলাদা ? তাঁর হৃদয়ে ঈর্ষা তৈরি হতে লাগলো । সে তখন জীবটিকে দেখার জন্য গেল । আদমের আকৃতি তাঁর কাছে খুব একটা অসাধারণ কিছু বলে মনে হল না । সে এটাতে টোকা দিল, ধাক্কা দিয়ে দেখল এটা থেকে ফাপা আওয়াজ আসছে । একই সাথে সে এটার ভেতর দিয়ে চলাফেরা করতে সক্ষম হল ।

সে বুঝলো যে জীবটি নিরেট নয় । সে ভাবল এটা অতিশয় দুর্বল  প্রাণী । অথচ একই সাথে সে যতবার এসে আদম কে দেখত,সে ভীত হয়ে পড়ত । সে তাঁর ভয় কে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেছিল । আল্লাহ যে সময় জুড়ে তাকে ফেলে রাখলেন, পুরো সময়টি জুড়ে আদমের প্রতি ইবলিসের ঈর্ষা শুধু বেড়েই চলল । আস্তে আস্তে এই হিংসা গৌরবে পরিণত হল । সে বলল ,যদি আমাকে তোমার উপরে ক্ষমতা দেয়া হয় তবে আমি তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাব । আর তোমাকে যদি আমার উপরে প্রাধান্য দেয়া হয় আমি তোমাকে অমান্য করব ।

ভেবে দেখুন তো ,আদম আঃ এর শরীরে তখনও প্রাণ আসেনি, প্রাণশূন্য মাটির দেহ পরে রয়েছে । অথচ ইবলিস এর মধ্যেই শত্রুতা শুরু করে দিয়েছে ।

আদম কে সম্মানিত করে হয়েছিল কারন তাকে আল্লাহ্‌ নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন ।  রসুলুল্লাহ সঃ বলেছেন (মুসলিম থেকে বর্ণিত) , আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা আদমকে তৈরি করেছেন তাঁর নিজের চেহারায় । এই কথাটার অর্থ কি ? এর অর্থ হলো  আদম  আঃ আমাদের মত জীবনের বিভিন্ন পর্যায় গুলো দিয়ে আসেননি,ভ্রুন থেকে শিশু,তারপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত, আদম আঃকে বানান হয়েছে একরূপে , প্রথম দিন থেকেই তাকে তাঁর চেহারাতেই সৃষ্টি করা হয়েছে ।

আল্লাহ্‌ এরপর আদমের শরীরে রুহ ফু’কে দিলেন । যা আমাদেরকে জীবন দেয়, তাঁর ই নাম রুহ, বা আত্মা,জীবন নামক রহস্যের মূল যা আল্লাহ্‌ সুবহানা ওয়া তা’আলা গোপ্ন রেখেছেন, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম শিখরে এসেও রহস্যই রয়ে গেছে । যখন প্রথম বারের মত রুহ আদমের শরীরে প্রবেশ করল, সর্বপ্রথম যা ঘটলো তা হল তিনি হাঁচি দিলেন এবং বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র’) ।  এবং উত্তরে আল্লাহ্‌ বললেন , ‘ইয়ারহামকাল্লাহ’ (তোমার উপরে আল্লাহ্‌র রহমত) ।

এটাই প্রথম কথা যা সাইয়েদিনা আদম কে বলা হয়েছিল । তাঁর উপরে আল্লাহ্‌র রহমত ছিল শুরু থেকেই । তাঁর রুহ তখনও তাঁর পুরো শরীরে পৌঁছায়নি, শরীর দিয়ে নিচে নামার সময় তা যখন পাকস্থলী তে পৌঁছে, তিনি ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছেন জান্নাতের অপূর্ব সব ফলমূল , সেগুলোর নাগাল পাবার জন্য তিনি লাফ দিলেন অথচ রুহ তাঁর পা পর্যন্ত পৌছেনি । এবং তখনি আল্লাহতা’আলা তাঁর ডান দিক দিয়ে আদমের পিঠ মুছে দেয়া মাত্র তাঁর সকল বংশধররা বেড়িয়ে আসলো ,কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে । তখন আল্লাহ্‌ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের মালিক নই ?’;

সবাই একসাথে বলল , ‘হ্যা ও আল্লাহ,আপনিই আমাদের মালিক’ । আদম জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা ? আল্লাহ্‌ পাক বললেন ‘এরা তোমার বংশধর’ । আদম আঃ তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে তাদের মধ্যে একজনের দুই চোখের মাঝে  উজ্জ্বল আলো জ্বলছে । আদম তা পছন্দ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন ইনি কে ? আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়া তা’আলা বললেন এও তোমারই এক উত্তরাধিকারি যে সময়ের শেষ দিকে আসবে,তাঁর নাম দাউদ । তাঁর বয়স কত ? তিনি আবারো প্রশ্ন করলেন । উত্তরে আল্লাহ্‌ পাক বললেন ‘ষাট বছর’ । এরপর তিনি আল্লাহ্‌ তা’আলাকে বললেন, ‘ ও আল্লাহ্‌ তাকে আমার জীবন থেকে ৪০ বছর দিয়ে দিন ’ । অতঃপর তা সিল করে দেয়া হয়েছে ।

আল্লাহ্‌ পাক আদমকে দূরে থাকা ফেরেশতাদের কাছে গিয়ে তাদের কাছে সালাম পৌঁছে দিতে বললেন । তিনি ফেরেশতাদের কাছে গেলেন এবং বললেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ । তারা উত্তর দিল, ‘আলাইকাসসালাম ওয়া আলাইকা আস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু  (আল্লাহ তা’আলার শান্তি,ক্ষমা, দয়া ও আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হোক) । তখন আল্লাহ্‌ তাকে বললেন , ‘এটা তোমার ও তোমার বংশধরদের জন্য অভিবাদন,তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ । এরপর তিনি আদম আঃ কে ফেরেশতাদের সামনে দাড়া করিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন , ‘আদমকে সিজদাহ কর’ । সবাই আল্লাহ্‌ পাকের আদেশ পালন করল, শুধু মাত্র ইবলিস ছাড়া । সে অস্বীকৃতি জানালো ও বললো, আমি তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে !



আল্লাহ্‌ পাক তখন তাকে জান্নাত থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন আর বললেন, ‘তুমি শ্রেষ্ঠ নও,বরং তোমার গর্বের কারনে তুমি নিকৃষ্টতর’ ।

ইবলিস তখন বলল, ‘ এই নির্বোধ প্রাণী টাকে দেখুন,আমি এর জন্য ওঁত পেতে থাকবো, আমি এদের উপরে আসবো তাদের সামনে দিয়ে,তাদের পেছন দিয়ে,তাদের ডান ও বাম দিক দিয়ে এবং আপনি এদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে পাবেননা ’ ।

আল্লাহ তা’আলা বলেন যে তিনি শিখিয়েছেন আদম কে সব কিছুর নাম । এরপর তিনি কিছু বস্তু ফেরেশতাদের সামনে এনে রাখলেন । এবং অতঃপর তিনি তাদেরকে এগুলোর নাম বলতে বললেন । ফেরেশতারা বললেন , ‘সকল প্রশংসা আপনার, আপনি যতটুকু দিয়াছেন তাঁর বাইরে আমাদের কোন জ্ঞ্যান নেই ’ । তখন আল্লাহ্‌ আদম আঃ কে ডেকে বস্তুগুলোর নাম তাদের কাছে বলতে বললেন । তিনি যখন সবগুলোর নাম বলে দিলেন তখন আল্লাহ্‌ পাক তাঁদের বললেন, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু লুক্কায়িত আছে, আমি জানি যা প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত  এবং আমি জানি নির্ভুলভাবে যা তোমা বলাবলি করছিলে যে আল্লাহ্‌ তোমাদের থেকে বেশি জ্ঞ্যানী ও বেশী সম্মানিত কাউকে সৃষ্টি করবেননা ? ’

এভাবে আল্লাহ্‌ পাক সৃষ্টি করলেন আদম’কে এবং তাকে থাকতে দিলেন জান্নাতে । বেশ কিছুদিন জান্নাতে থাকার পর আদম আঃ উদাস এবং নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলেন । একদিন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন , তিনি তাঁর পাশে দেখলেন তাঁর স্ত্রী কে , ‘হাওয়া’ ,একজন মহিলা মানুষ । তাকে দেখে আদম আঃ এর একাকিত্তবোধ অবিলম্বে চলে গেল । তিনি তাকে জিগ্যেস করলেন ‘মান আনতি ?’ (তুমি কে?) ।

হাওয়া উত্তর দিলেন ,  ‘আল্লাহ্‌ আমাকে সৃষ্টি করেছেন যেন তুমি আমার মাঝে তোমার প্রশান্তি ও স্থিতি খুজে পাও ’ ।

আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা তখন তাঁদেরকে বললেন, ‘এই জান্নাত থেকে তোমরা যা ইচ্ছে তা ভোগ কর, কিন্ত ওই যে একটা গাছ দেখতে পাচ্ছ, ওটার কাছে যাবার অনুমতি তোমাদের নেই নচেৎ তোমরা নিগৃহীতদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে ’ ।

এছাড়া আল্লাহপাক তাদেরকে ইবলিসের ব্যপারে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘সে তোমার ও তোমার বংশধরদের শত্রু, তাঁর কাছেও যেওনা ’।

এরপর একসময় ইবলিস তাঁর কাছে এসে বলল ‘ও আদম, তুমি ওই গাছটি থেকে খাচ্ছনা কেন?’

আদম আঃ অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন , ‘আমি আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি ! আমার মালিক আমাকে এই গাছটির কাছে না যেতে আদেশ করেছেন ! দুর হও ’ । এভাবে ইবলিস বার বার তাঁর কাছে আসতো । বার বার সে চেষ্টা করতো আদম আঃ কে ধোকা দিয়ে আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করানোর জন্য । একসময় সে বুঝতে পারলো আদম’কে ধোকা দেয়া খুবই কঠিন একটা কাজ । তারপর ইবলিস কি করল ? তারপর সে হাওয়া’র কাছে গেল ।  সে বলল , ‘ভেবে দেখ আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে ওই গাছথেকে ফল খেতে নিষেধ করেছেন যেন ওটা থেকে খেয়ে তোমরা ফেরেশতাদের মত হয়ে না যাও, যেন অমর হয়ে না যাও’ ।
এভাবে সে বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগল । হাদিসে এটাও উল্লেখ আছে যে সর্বপ্রথম ইবলিসের ধোকায় হাওয়া পতিত হন । এরপর আদম আঃ ও ধোকাগ্রস্থ হন । যখন তারা গাছটার কাছে গেল, হঠাৎ করেই তাঁদের মধ্যে লজ্জাবোধ এসে পড়ল তাঁদের স্বল্প পরিচ্ছদের কারনে । প্রচণ্ড লজ্জাবোধের কারনে তারা জান্নাতের গাছের পাতা গুলো নিয়ে নিজেদের কে ঢাকতে লাগলেন । আদম আঃ দৌড়ে গেলেন । তাই আল্লাহ্‌ পাক তাকে জিজ্ঞেস করলেন  ‘ও আদম,তুমি কোথায় দৌড়ে যাচ্ছ? তুমি কি আমার কাছ থেকে দৌড়ে পালাচ্ছ ?’

সে বলল ‘না ও আল্লাহ্‌, আমি আপনার কাছে অনুতাপ বোধ করছি’ ।

‘আমি কি তোমাদেরকে এই গাছ থেকে খেতে নিষেধ করি নি ? এবং তোমাদের বলেছি যে শয়তানের কথা শুনোনা ,যে সে তোমাদের শত্রু ?’

তখন তারা বলল ‘ও আল্লাহ্‌ আমরা নিজেদের উপরে অন্যায় করে ফেলেছি,  আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন তাহলে আমরা তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব যারা সব হারিয়েছে’ ।

তখন আল্লাহ্‌ পাক বললেন, ‘তোমাদের কে এখন পৃথিবীতে নেমে যেতে হবে, এবং সেখান বেচে থাকার জন্য তোমাদেরকে চাষাবাদ করতে হবে, জীবিকা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে’ ।

তখন তারা বলল ‘ও আমাদের মালিক আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন তবে আমরা অভাগাদের শ্রেণীতে পড়ে যাব’ ।

তারা খুবই ব্যাথিত হয়ে পড়েছিলেন, তারা আল্লাহকে দোষ দেননি , ইবলিসকেও দোষ দেননি বরং তারা নিজেদেরকে দূষতে ছিলেন । এই বলে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন যে তারা নিজেদের উপর অন্যায় করে ফেলেছেন, এবং আল্লাহ্‌ পাক তাঁদের ক্ষমা করে দিয়াছিলেন । আদম আঃ এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন ।

তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং জীবনে দ্বিতীয়বার আর পাপ করেননি । যদিও তাকে পৃথিবীতেই থাকতে হয় । এতে বৃহত্তর শিক্ষণীয় বিষয় আছে,মনে রাখতে হবে এটা শাস্তি ছিলনা । বলা হয় যে আদম আঃ অবতরন করেছিলেন ইন্ডিয়ায় এবং হাওয়া মক্কার কাছাকাছি । অতঃপর তারা একজন আরেকজনের খোজ করতে শুরু করলেন । তারা একজন আরেকজন কে খুজে পেলেন আরাফাত এর পাহাড়ে । সেখানে, তারা নতুন করে এই পৃথিবীতে তাঁদের জীবন শুরু করলেন ।

তাঁদের দুজন দিয়েই শুরু হল মানব জাতির ইতিহাস । আদম আঃ এর স্ত্রী, হাওয়া, তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন কুড়িবার । প্রতিবারই তিনি যমজ শিশু জন্ম দিতেন ।  একটি ছেলে ও একটি মেয়ে । আদম আঃ তাঁর বংশধরদের অসংখ্য প্রজন্ম দেখে গিয়েছেন । এই পৃথিবীতে তিনি বেচে ছিলেন নয়শত ষাট বছর । তাঁর বাচার কথা ছিল এক হাজার বছর , কারন আল্লাহপাকই তাকে বলেছিলেন যে তিনি ততটূকু সময় বাচবেন । আর যখন বছরের পর বছর চলে গিয়ে তিনি নয়শ ষাট বছর বয়স্ক হলেন , জীবন হরণকারী ফেরেশতা তাঁর কাছে আসল এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘আপনি কি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছেন ?’ এর কারন জান কবজকারি ফেরেশতা সবসময় নবী ও রাসুলদের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহন করেন ।

আদম বললেন , ‘আমার তো আরও চল্লিশ বছর আছে ,আল্লাহ্‌ পাক’ই তো আমাকে এক হাজার বছর সময় দিয়েছেন !’ তখন ফেরেশতা বললেন ‘আপনি কি আপনার আয়ু হতে ৪০ বছর আপনার সন্তান দাউদ কে দেননি ?’ আদম আঃ তা অস্বীকার করলেন । তাই তাঁর সন্তানেরাও একই ভাবে অস্বীকার করে ।

তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁর সন্তান, মানুষেরাও ভুলে যায় । তিনি ভুল করেছিলেন, তাঁর সন্তানেরাও ভুল করে । এটাই মানুষের বৈশিষ্ট । আর আমরা যখন ভুলে যাই, তখন আমরা অস্বীকার করি । আদম আঃ ৪০ বছর দাউদ আঃ কে দেবার কথা অস্বীকার করেছিলেন কারন তিনি ভুলে গিয়েছিলেন । আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে তিনি মিথ্যা বলেননি ,তিনি মনে রাখতে পারেননি এবং তিনি আল্লাহ্‌র ক্ষমা পেয়েছিলেন । তিনি আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্নসমর্পণ করেছিলেন ।



আদম আঃ যখন মৃত্যু সজ্জায় তাঁর চারপাশে তাঁর সন্তানেরা ঘিরে ছিল । তখন তিনি বললেন,‘আমার ইচ্ছে করছে জান্নাতের ফল খেতে’।

তাই তারা সবাই মিলে জান্নাতের ফল খুজতে বের হল, আর যাওয়ার পথে তারা অদ্ভুদ একদল মানুষের দেখা পেল । তারা প্রকৃত পক্ষে ছিল আল্লাহ্‌র ফেরেশতাগন,তাঁদের হাতে ছিল মাটিতে কবর খোড়ার সরঞ্জাম , আর ছিল মৃত কে ঢেকে দেবার জন্য কাপড় । তারা বলল যে ‘আমরা আমাদের পিতার জন্য জান্নাতের ফল আনতে বের হয়েছি’ । তখন ফেরেশতারা বললেন, ‘ফিরে যাও, তোমাদের পিতা তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন’। তাই তারা ফিরে গেল, ফেরেশতাদের সাথে নিয়ে ।

যখন ফেরেশতারা ঘরে প্রবেশ করলেন হাওয়া তাঁর পাশে বসে ছিলেন । তিনি তাদেরকে দেখেই বুঝে ফেললেন যে তারা ফেরেশতা । তখন তিনি আদম আঃ কে আকড়ে ধরলেন, তিনি তাঁকে হারাতে চাননা । তখন আদম আঃ বললেন, ‘আমাকে যেতে দাও, তোমার মাধ্যমে আমি আল্লাহকে অমান্য করেছি ’ ।

তখন ফেরেশতারা আদম আঃ এর রুহ বের করে নিলেন  এবং তারা আদম আঃ এর মৃত দেহ নিয়ে বেড়িয়ে আসলেন আদম আঃ এর অগণিত সন্তান সন্ততিদের মাঝে ।

এরপর ফেরেশতাগণ তাঁদের সামনে আদম আঃ এর মৃতদেহ কে সুন্দরভাবে ধুয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন ও তাঁর জন্য প্রার্থনা করলেন । অবশেষে তারা আদম আঃ কে নিয়ে কবরে শায়িত করলেন এবং কবরের উপরে বালি রেখে দিয়ে তাঁর বংশধরদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এভাবেই তোমরা তোমাদের মৃতদের কে কবর দেবে’ ।

Leave a Reply