ওহে কর্পোরেট ডাকাত

কর্পোরেট ডাকাত

‘কর্পোরেট’ শব্দটি শুনলেই সবার প্রথমে মাথায় আসে অর্থ, বিশাল আকারের কোন কার্যকলাপ আর সদ্য বের হওয়া যুবকের কাছে চাকুরীর জন্য সি. ভি. জমার দেয়ার সুযোগের হাতছানি।

এই কর্পোরেশন কিংবা সোজা বাংলায় বললে বিশাল আকৃতির প্রতিষ্ঠানগুলিই আজকের আলোচনার বিষয়।

কর্পোরেশন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে গেলে প্রথমেই আসে কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা। এই বিশাল আকৃতির প্রতিষ্ঠান আবার কীভাবে পায় কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা? হ্যাঁ, সিস্টেম, আইন এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির ন্যায় অভিনয় করে আর তাকে দেয়া হয় মর্যাদা, সম্মান কিংবা অধিকার।

কীভাবে টিকে থাকে এই কর্পোরেশন? আছে হাজার রকমের স্ট্রেটেজি, টেকনিক। বিক্রি বাড়াতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে আর তার সাথে কমাতে হবে উৎপাদন খরচ।

তা না হলে বাজারে টিকে থাকা দুস্কর হয়ে যাবে। প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করতে হবে নিজেকে, চিন্তা করতে হবে আউট অভ দ্যা বক্স; আরও কত কি!
কিন্তু এই ক্রিয়েটিভিটির বয়ান হচ্ছে ধান্দাবাজি। কেন বলছি? একটু উদ্দেশ্যের দিকে খেয়াল করে দেখুন। উদ্দেশ্য কী আসলে? মুনাফা, সম্পদ বর্ধন ছাড়া আর কিছুই না।

সম্পদ সীমাবদ্ধ, আরও সীমাবদ্ধ হচ্ছে দিনের পর দিন যেহেতু প্রকৃতিকে চাপ দিয়ে বের করা হচ্ছে সব সম্পদ। তবে কীভাবে আসবে এই কম খরচে উৎপাদনের ব্যাপারটি? কাঁচামালে হাত দেয়া যাচ্ছে না যেহেতু সরবরাহকারীও তার বিজিনেস টিকিয়ে রাখতে চাইবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি কি করতে পারে তাহলে? উপায় হচ্ছে কষ্টে খেটে খাওয়া নিরীহ শ্রমিকদের অর্ধেকের অর্ধেক মজুরি দিয়ে গোঁজামিল দেয়া। আর এই শ্রমিকরা কি কম মজুরির ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে? উত্তর “না”। তারা তো প্রতিষ্ঠান না যে মামলা করে জিততে পারবে বিশাল কর্পোরেটের বিরুদ্ধে যেখানে হাজার টাকা বেতনে দালাল কর্পোরেট আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়। আর কৃত্তিম ভাবেই মামলা করে জিতে যায় এই কৃত্তিম কর্পোরেট।

হাঁ, আরও উপায় আছে মুনাফা বৃদ্ধির। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে কম দিতে পারলেই যেন রাম রাম করে বাঁচতে পারে তারা। আর পণ্যের গুনগত মান কমিয়ে বেজাল মিশানোর কথা বাদ দিলাম এখন।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ভণ্ডামির যে সীমা নেই। ভণ্ডামির নাম সামাজিক বাজারজাতকরণ যখন তারা মানবাধিকার কাজে নিজেদের সজাগ করে ফেলে। তারা দেশের কল্যাণ করছে, সমাজের উন্নয়নে রয়েছে বিশাল অবদান। তৈরি করে রেখেছে বিখ্যাত লোকদের যারা স্পন্সর করবে তাদের প্রোডাক্ট। আর সেই বিখ্যাত টাকার বিনিময়ে বিক্রি হওয়া ছোটলোকদের মাথায় করে আমরাই নাচি যেখানে আমাদেরকেই ঠকানো হচ্ছে।

আর বিজ্ঞাপন এমন ভাবে দেখানো হয় যে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও আপনাকে বাধ্য করা হয়। এ যেন ভণ্ড পীরের যাদুর খেলা। তারপরে আপনি কিনে একটু একটু করে ধ্বংস করেন আপনার আরামদায়ী পরিবেশ আর তার বিনিময়ে পরিবেশ থেকে আসে ক্যান্সার, দুরারোগ্য ব্যাধি। এ যেন নিজেই খাল কেটে কুমীর আনছেন।

আবার সেই কোম্পানিকে দেখা যায় পরিবেশবাদী কর্মকাণ্ডতে। বৃক্ষ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানো যেন তার মহা দায়িত্ব ছিলো। বলতেই পারেন কাজগুলো তো ভালোই করেছে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তবে কতটা ধ্বংস করে এই লোক দেখানো কাজ। আমার কাছে মনে হয় পরিবেশ রক্ষায় তাদের কোন মন নেই। এটি শুধুমাত্র তাদের একটি বিজ্ঞাপন প্রক্রিয়া। আমরা যখন সামাজিক বাজারজাতকরণ পরেছিলাম তখন এই টেকনিকগুলি নিয়ে শিক্ষক মহাদয় আলোচনা করতেন। করনাকালীন সময়ে দেখবেন অনেক কোম্পানি আছে যারা তাদের সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছে “আমরা পাশে আছি, এই বিপদে সবাই এক সাথে”। যদি জিজ্ঞেস করেন কীভাবে পাশে আছেন? তবে সৎ উত্তর হবে আমরা আমাদের পণ্য বিক্রি করতে এই ধরনের ইমোশনাল ট্যাগলাইন ব্যাবহার করি। যারা এই বিজ্ঞাপন বানায় কিংবা কর্মচারী, মালিক তাদের নিজেদের কতটুকু ক্ষমতা আছে নিজেদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। এক ভ্রান্তি চক্রে তো তারা নিজেরাও ঘুরছে যেখানে অর্থ দিয়ে কিনে নেয়া হচ্ছে সান্ত্বনা। সত্যি বলতে ভণ্ডামিতে ছেয়ে গেছে এই জগত।

কিছু কিছু কোম্পানি আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বিপক্ষে কমিউনিটি তৈরি করে বা তাদেরকে স্পন্সর করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই। মানুষের মাঝে ভুল তথ্য দিয়ে সচেতনতা রুখে দেয়া। মানুষ সচেতন হলে বা ইলিউশন দূর হলেই তো খেল খতম। বিক্রি শেষ। সেলস রিপোর্ট ফাঁকা। কাকে দেখাবে তাদের ম্যানহাটেনের মিলিয়ন ডলারের এপার্টমেন্ট।

এইবার আমাদের দেশের কথাই একটু চিন্তা করেন না! আমরা কৃষিপ্রধান দেশ। মাটি উর্বর। ফসল, ভাতে মাছে বাঙালি হয়েও সুতা আর বুতামের দেশে পরিনত হয়েছি। ধ্বংস করছি উর্বরতা। সৃষ্টিকর্তার কল্যাণকর উর্বর ভূমি এখন আমদের কাছে ইট বালু, সিমেন্টের তৈরি কারখানা। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত পরিশ্রমে হাড় ক্ষয় করছে আমাদের ভাই বোনেরা। কিন্তু পাচ্ছে কি ন্যায্য বেতন কিংবা মজুরি? কর্পোরেট জ্ঞানের দোহাই দিয়ে লভ্যাংশের সবটুকুই তো নিয়ে যাচ্ছে সেই দালালেরা। তারপরে সামান্য কিছু পায় মিড লেভেল ম্যানেজারেরা আর শ্রমিক, মানে যারাই আসলে হোতা তাদেরকে তো দেয়া হয় দীক্ষা।
এখন আবার শুনা যাচ্ছে গার্মেন্টস না থাকলে নাকি অর্থনীতি শেষ। হ্যাঁ ওই অর্থনীতিই শেষ হবে যেটিতে থাকে না খেটে খাওয়া জনগণের জীবনের অর্থ । হ্যাঁ, সেই অর্থনীতি যেখানে কৃষক বাবা জানে না তার উৎপাদিত ফসল কেউ কিনবে কিনা নাকি আবারও রাগে ক্ষোভে  ট্রাকের নিচে চাপা দিতে হবে সোনার ফসল। অথচ সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসিই তো খাদ্য আর যা উৎপাদন করে কৃষক। মাঝে মাঝে তো সেই কর্পোরেট মহাশয়েরা ব্যাবহার করে তাদের গালি “চাষা”, “ক্ষেত”। যেন কৃষকদের কোন ক্লাস নেই, নেই কোন মর্যাদা। অশিক্ষিত, বন্য! আচ্ছা, মহাশয়েরা না খেয়ে থাকেন তাহলে। আপনাদের দরকার নেই কৃষকদের উৎপাদিত জিনিস। দেখা যাক, আপনাদের “শিক্ষা” পেটে ভর্তি রাখতে পারে কিনা।

শিক্ষার মানে এই না যে গলায় রশি ঝুলিয়ে আর গরমের ভিতরে পায়ে লোহার শিকল পরে হাটা চলা করা। শিক্ষা হচ্ছে অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। জগত কে জানা। সম্মান করা। নিজের প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধতা, ভণ্ডামি স্বীকার করে অন্যকে সম্মান করা। শিক্ষার মানে এই না বুকের ভিতর প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের সার্টিফিকেট আগলে রেখে বড়াই করা।

পৃথিবীতে কোট টাই পরা ভদ্ররাই অংশ গ্রহণ করে ডাকাতিতে। এখনকার দিনের ডাকাতেরা চোখে কালো কাপড়ের পট্টি বাঁধে না। তারা দেখতে কেমন হয় ভালো করেই জানেন আপনি!

তবে একটা জিনিস সত্যি যে মোটামুটি আমরা কেউই নিষ্পাপ না। তবে কেন এই শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার খেলা? এত অস্বচ্ছলতা কেন? কেনই বা রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে ভালো হওয়ার চেষ্টা? আমাদের অনুকূলের পরিবেশ ধ্বংস হবেই। আপনি আমি পরিবেশ রক্ষা করতে পারবো না। ওহ দুঃখিত, পরিবেশ ধ্বংস হয় না। কারন পারমানবিক বোমা পরার পরেও নাগাসাকি হিরোশিমাতে পরিবেশ ছিলো। তবে মনুষ্য অনুকূলে ছিলো না। আমরা পরিবেশ বলতেই তো বুঝি চারপাশের যা কিছু আছে, তাই নয় কি?

তবে বলে রাখা ভালো, দয়া করে গর্ব করবেন নয়া বা জাস্টিফাই! বারাক অবামা ডাস্টবিনকে পদ্ম বললে, সেটি পদ্ম হয়ে যাবে না, সেটি ডাস্টবিনই থাকবে। আপনি যত টাকার মালিকই বা সারতিফিকেটধারী শিক্ষিত ক্ষমতাবানই হন না কেন আপনার কথায় চিড়ে ভিজানোর প্রক্রিয়ায় বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না। আপনার কৃতকর্মকে ভালো হিসেবে দেখানোর চেষ্টা কখনই ওই কৃতকর্মকে ভালোতে রূপান্তর করবে না। বরং ঘোলাটে করবে। স্বীকার করে নেয়াটাই শ্রেয়। এতে তৈরি সততার জায়গা যেটি দরকার এই সমাজে। স্বতন্ত্র বলে তো কথা আছে!

সমাজ অদ্ভুত। তাই আর অস্বাভাবিক লাগে না এই বিষয়গুলি।

Leave a Reply