বিবাহ বিচ্ছেদে আমেরিকান দম্পতিরা কেন সম্পত্তি ভাগ করে

বিবাহ বিচ্ছেদে আমেরিকান দম্পতি

তালাকেরই মানেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ, একটি পরিবারের ভাঙন। সন্তান হারায় পিতামাতার স্নেহে বেড়ে উঠার সুযোগ। বিবাহ বিচ্ছেদের কারনে একটি শিশুর সামাজিকীকরণে মারাত্মক প্রভাব পরে। তারপরেও তালাক দেওয়া থেমে নেই। বাস্তবতা এমন পর্যায়ে চলে যায়, সম্পর্কটিকে টিকিয়ে রাখা হয়তো সম্ভবপর হয়ে উঠে না।

দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ এর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩৯টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। মানে, প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি ডিভোর্স। পুরো বিশ্বেই এই স্পর্শকাতর বিষয়টি ঘটে। তবে আইনি ব্যবস্থা, বিচ্ছেদ পরবর্তী কার্যক্রমগুলি দেশ ভেদে ভিন্ন হয়।

আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করে দিতে হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রীর উপার্জিত আয় থেকে ক্রয়কৃত সম্পদের ভাগাভাগি হয়। আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে। তাদের এই আইনের পিছনেও যুক্তি আছে। কী যুক্তি কাজ করে সেটি নিয়ে তাহলে আলোচনা করা যাক। আচ্ছা, আগে একটু খোলাসা করে নেয়ার দরকার ডিভোর্সের পর হয় কি, মানে আর্থিক প্রভাব কি!

 

Happy Holding Hands — Bill & Melinda Gates Give it Away Now
Attribution: “Happy Holding Hands — Bill & Melinda Gates Give it Away Now” by jurvetson is licensed under CC BY 2.0

২৫ বছর একসাথে থাকার পর ২০১৯ এর ৫ জুলাই অ্যামাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি বেজোস বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। এই ডিভোর্সে জেফ বেজোসকে গুনতে হয়েছিলো ৩৮ বিলিয়ন ইউ এস ডলার। আর এতেই ম্যাকেঞ্জি বেজোস হয়ে গিয়েছিলেন পৃথিবীর চতুর্থ ধনী মহিলা।

টেক জগতের আইকন বিল গেটস এবং মেলিন্ডা গেটসের ২৭ বছরের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ইতির নিষ্পত্তি মূল্য হতে পারে প্রায় ১৬৪ বিলিয়ন ডলার।

বড় অংকের দুটি ডিভোর্স আলোচনায় আসা তো স্বাভাবিক! সাধারনদের মাঝেও প্রতিনিয়ত হচ্ছে ডিভোর্স। তার সাথে চলে আইনি লড়াই আর ধস্তাধস্তি। মাঝে মাঝে ডিভোর্স হয়ে উঠে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার উপায়।
ন্যায্য বণ্টন আইন অনুযায়ী, যখন কোর্ট দ্বারা ডিভোর্স অনুমোদন পায়, তখন নিষ্পত্তি হিসেবে সম্পত্তি সমভাগে বন্টিত হয়, যদিও সব ক্ষেত্রেই এমনটি নাও হতে পারে। আচ্ছা, সমভাগে না বলে বলার দরকার ছিলো ন্যায্য ভাবে। কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয়, কিভাবে ভাগ করলে তা ন্যায্য হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ৫০-৫০ই হয়ে থাকে। তবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে তাই হবে। অনেক ক্ষেত্রেই আইনজীবীর কেইস উপস্থাপনের উপরেও নির্ভর করে। কোর্টে গিয়ে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই আয় ও দায় প্রকাশ করতে হয়।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে এখানে। বৈবাহিক সম্পত্তি শব্দ দুটি ব্যাবহার করা হয় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে। বৈবাহিক সম্পত্তিই মূলত নিষ্পত্তির বিষয়বস্তু । তাহলে বৈবাহিক সম্পত্তিটা আবার কী? আচ্ছা জেনে নেই, বৈবাহিক সম্পত্তির প্রেক্ষাপট ।
বিয়ের পর যেই সম্পত্তি ক্রয় হয়েছে তাই বৈবাহিক সম্পত্তি। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কোন সম্পত্তি দুইজন মিলে কিনলে কিংবা দুজনের নাম থাকলেই কি বৈবাহিক সম্পত্তি হবে? না, ঠিক তা নয়। স্বামী কিংবা স্ত্রী যেই কিনুক না কেন কিংবা যার নামেই কিনুক না কেন, সেটিই বৈবাহিক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

ধরুন, জনাব ডেভিড যদি কোন সম্পত্তি নিজের আয়ের উৎস থেকে বিবাহে থাকা অবস্থায় নিজের নামে কিনে, সেক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নিষ্পত্তিতে এই সম্পদের ন্যায্য ভাগ হবে। এমনকি অর্ধেকের বেশিও পেয়ে যেতে পারে ডেভিডের স্ত্রী। হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে বলছি, আর এটিই হয়তো আমাদের দেশের অনেকেই মেনে নিতে পারবে না। যাইহোক, তবে স্বামী কিংবা স্ত্রী যদি উপহার পায় কেউর কাছ থেকে, তাহলে সেটি বৈবাহিক সম্পতির ভিতরে আসবে না। এটিকে বলা হয় পৃথক সম্পত্তি।

পৃথক সম্পত্তির মধ্যে আছে বিবাহ পূর্ববর্তী সম্পত্তি। আবার স্বামী কিংবা স্ত্রী উত্তরাধিকার সূত্রে যদি কোন সম্পত্তি পেয়ে থাকে, তাও পৃথক সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। পৃথক সম্পত্তি ডিভোর্স নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আসবে না। তবে, বিবাহ পূর্ববর্তী টাকা দিয়ে বিবাহে থাকা অবস্থায় সম্পত্তি ক্রয় করলে তা বৈবাহিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে পেনশনের টাকাও বৈবাহিক সম্পত্তি। একারনেই মাঝে মাঝে আপনি আমেরিকান কমিক্সদের বলতে শুনে থাকবেন যে, আমেরিকান পুরুষেরা ডিভোর্সের পর নিজের সন্তান হারানোর সাথে সাথে হারায় বাড়িও , তারপরে সেই বাড়িতে থাকে সাবেক স্ত্রীর নতুন স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ড। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিষ্পত্তিতে স্বামীর চাইতেও বেশি সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে বসে স্ত্রী।

divorce 619195 960 720
Attribution: stevepb, https://pixabay.com/images/id-619195/

এর পিছনে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয় যদিও। আমরা হয়তো অনেকেই জানি, যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষ এবং মহিলারা কর্মজীবী হয়ে থাকে। তবে বিয়ের পর সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পরে দেখা যায়, স্ত্রীর কাজ করার সুযোগ হয়ে উঠে না। কিংবা এরপরে ক্যারিয়ার অগ্রসর হয় না। তাই বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীকে এই সাপোর্টটি দেয়া হয়ে থাকে যাতে করে তার পরবর্তী জীবনে আর্থিকভাবে ভোগান্তিতে পরতে না হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে স্বামীর চাইতে স্ত্রীর আয় বেশি, সে ক্ষেত্রেও স্বামী ডিভোর্সের নিষ্পত্তির আর্থিক বণ্টনে অংশ নিতে পারে। আর এখানে একটি বিষয় চিন্তা করা হয় যে, স্বামী স্ত্রীর যখন একটি পরিবারে থাকে, তখন তাদের একটি সম্মেলিত ইউনিট চিন্তা করা হয়, যেখানে সম্পত্তি অর্জনে দুইজনেরই ভূমিকা আছে, যেই আয় করুক না কেন।

যদিও এই যুক্তিটি অনুযায়ী স্বাভাবিক কিংবা সঠিক মনে হতে পারে আইনকে। তবে, এই আইনের বেড়াজাল তো আছেই। তারপরে আছে আইনজীবীদের চতুর কৌশল যেখানে হয়তো আয় উপার্জনকারী তার উপার্জিত অর্থের অর্ধেকেও পায় না।

আবার অনেকে এই ডিভোর্সকে আয়ের উৎস হিসেবেও তৈরি করে বসে। এতে করে পরিশ্রমের সব ফসল ভোগ করে অন্য কেউ। এটি হয়তো ডিভোর্সের হার বৃদ্ধি করার পিছনেও দায়ী।

আমাদের দেশের দেনমোহরেও ইদানীং এই অবস্থার রংচটা দেখা যায়। ৩০ লক্ষ কিংবা আরও বেশি টাকার দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করার পর ভেঙ্গে যায় সংসার। তারপর পরিশোধ করতে হয় বিরাট অংকের টাকা।

অনেকেই আবেগের বশীভূত হয়ে অনেক টাকা দেনমোহর দিয়ে করে বসেন বিয়ে। চিন্তাও করেন না, এই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন। কারন সেই সময় কোন স্বাভাবিক ব্যক্তি কি ডিভোর্সের ব্যাপারে ভাবেন! বিয়ের আগে ডিভোর্সের চিন্তা হাস্যকর যদিও, তারপরেও নিজের সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিৎ। এতে করে সকলেরই সুবিধা হয়। ভবিষ্যৎ তালাকের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে।

এই জগত সংসার অদ্ভুত। বিশ্বে আইনের বৈচিত্র্য যেমন আছেন তেমনই আছে আইনের ফাঁদ দিয়ে অন্যায় করার বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যের মাঝে ন্যায্য বিচার না পাওয়াই যেন স্বাভাবিক এবং সাধারণ। কোন নিরীহ মেয়ে স্বামীর হাতে বছরের পর বছর নির্যাতিত হতে থাকে আবার কোন নিরীহ পুরুষকে বিপদে ফাঁসিয়ে লুট করে নেয়া হয় তার আর্থিক সম্পদ, মানসিক শক্তি।

বাস্তবতায় আইন তৈরি করা হয় যাতে মানুষ ন্যায় বিচার পায় কিংবা অন্যায়ের দিকে যেতে ভয় পায়। তবে এই আইনকেই দেখা যায় অন্যায়ের উৎস হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। আইন দিয়েই চলে অন্যায়ের জগত। যেখানে আইনজীবীরা সাহায্য করবে অত্যাচারিতকে, সেখানে আইনজীবীরাই বাঁধা দেয় ন্যায় বিচার পেতে। আপনি সব সময়েই ভাবেন আইনের প্রতিষ্ঠা কেন হয় না, তবে হলেই বা কি!

মানুষের ভিতর নরকীয় বৈশিষ্ট্য যতদিন থাকবে ততদিনই অন্যায় থাকবে। কারন অন্যায়কারী কোন না কোন ভাবে অন্যায় করার পন্থা বের করে নিবেই। হতে পারে সেটি দেনমোহর দিয়ে লুটের ঘটনা কিংবা ন্যায্য বণ্টন আইনের ফাঁদ।

 

আরও পড়ুনঃ

https://bicchuron.com/2716/%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b8/

 

তথ্য সূত্রঃ

Featured image: klimkin,https://pixabay.com/images/id-995370/

https://onubhob.com/1719/israeli-palestinian-conflict-2021/

 

Leave a Reply