image source: https://pixabay.com
২০১২ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখ। বারটি হচ্ছে বৃহস্পতিবার। সফিকের সপ্তাহের এই বারটি সবচেয়ে প্রিয়। ঠিক যেই সপ্তাহ থেকে কলেজ জীবনের যাত্রা শুরু করেছে ঠিক ওই সপ্তাহ থেকেই। সফিক মানিকগঞ্জের সন্তান। কিন্তু ভালো পড়াশুনার জন্যে ঢাকার কলেজে ভর্তি হতে হয়। শহরে মন একবারেই টিকে না। মা আর মাটির কাছে তাকে যেতেই হবে সপ্তাহে একদিন। তাই সে শুক্রের বন্ধে বাড়ীতে যেতে ভুল করে না। ১৯ তারিখে ক্লাস শেষে যথারীতি গ্রামের ঠিকানায় রওনা দেয় সফিক। বিকেল তখন ৪.২০। যাত্রার প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়েছে। পথ যদিও কম, তবে যানজটের বেহাল দশাতে গাড়ি যেন থমকে আছে। ৩ ঘণ্টা পর ঢাকা ছাড়তে পারলো বাস। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ গতিতে।
পাশের সিটে বসা এক ভদ্রলক জিজ্ঞেস করল, কই নামবেন, ভাই?
সফিক উত্তর দিল, ‘জাইগিরে নামবো, তারপর গুরখি মাস্টার বাড়ি।’
আগন্তুক ভদ্রলোক বলল, ভাই ওইদিকের জন্য কিছু পাবেন এত রাত্রে! রিকসা-টুকশা কিছু নাই মনে হয়। আপনি বরং আমার সাথে বাজারের দিকে নাইমেন। ওইখানে রিকশা আছে।”
সফিক অনেকটা বিরক্তের সাথে বলল, “দেখি, কি হয়; কিছু না পাইলে হাইঠা যাবো।”
আগন্তুক ভদ্রলকঃ “এত রাত্রে ওই রাস্তায় হাইঠা যাওয়া কি ঠিক হবে?”
সফিক কোন উত্তর দিল না।
রাত ১০ টার দিকে বাস থামলো জাইগিরে। শুধু সফিকই নামলো বাস থেকে।
আগন্তুক লোকটি ভুল কিছু বলে নাই। রিকশা তো দূরের কথা, একটা মানুষও নেই। সফিক প্রায় ২০ মিনিট যাবত দাড়িয়ে আছে যদি কোন দেখা পায় রিকশার। নাহ, কোন কিছুর হদিছ নেই। হাটা শুরু করলো সফিক।
শীত খুব বেশিই পরেছিল ওইবার। কুয়াশাতে সব কিছু কালো। মোবাইলের লাইটও বেশি কাজে আসছে না। দূরের জিনিস দেখার উপায় নেই। শুধু নিঃশ্বাসের ধুঁয়া উড়ছে সফিকের কাছ থেকে। সফিক খুব ভীতু প্রকৃতির নাহ যদিও, তবুও ঠাণ্ডা আর পরিবেশটা কেমন যেন এক অদ্ভুত অবস্থা তৈরি করেছে।
সফিক হাঠছে। জোনাকির শব্দ নিস্তব্ধতাকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। তার সাথে আছে সঙ্গী পেঁচার ভুতুড়ে আওয়াজ। শ্মশানঘাঁটের কাছে আসতেই সফিকের বুকটা কেমন যেন থমকে উঠলো। খোলা মাঠের পরেই একটা ছোট্ট নদী। ঠাণ্ডা শুশু বাতাসের শব্দ আসছে। সফিকের খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। ঠাণ্ডাটা এখানে একটু বেশিই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। সফিক নিজের মনকে বুঝাল যে, নদীর পাশে থাকার কারনেই এমন মনে হচ্ছে। সফিক খুব দ্রুত শ্মশান মাঠের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হাঠছে। যত তাড়াতাড়ি পার হওয়া যায়। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন তাকিয়ে আছে দূর থেকে তার দিকে। একটু হাঠতেই আবার মনে হল এই বার সত্যি সত্যি কেউ পিছনে আছে। সফিক খুব চেষ্টা করছে পিছনে ফিরে না তাকানোর। পা হিম হয়ে যাচ্ছে। পা যেন আগাচ্ছেই না। কি যেন একটা অদ্ভুত শক্তি পা দুটোকে আটকে রেখেছে। এইবার মনে শক্তি নিয়ে আবার চেষ্টা করে হাঠা শুরু করলো। ব্রিজের সামনে প্রায় এসে গেছে। হঠাৎ সফিকের ফোনে রিং। “হেলো মা, আসছি আর ২০ মিনিট লাগবে”।
২০ জানুয়ারি সকালে, ব্রিজ থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে নদীর ধারে একটি লাশ আটকে আছে গাছের খুঁটিতে। মাথাটা নামানো। যেন শান্তিতে শুয়ে আছে কর্দমাক্ত মাটিতে। সারারাত খুঁজতে থাকা হতভাগা মা’র বুঝতে আর সময় লাগলো না যে তার বাবা বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে পরেছে।