শপিংমলে ভিড়
কিছু বলার আগে পরিসংখ্যান থেকে ঘুরে আসা দরকার। আজকের করোনা পরিস্থিতি যদি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নিয়ে পর্যালোচনা করি, তাহলে একটু হলেও বুঝা যাবে কোথায় করোনার পরিস্থিতি আছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক ড্যাশবোর্ড থেকে নেয়া তথ্য অনুযায়ী আজ মে ৯ এ বাংলাদেশে নতুন আক্রান্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৮৬ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ২৪ ঘণ্টায় ৫৬ জন।
যদি তুলনা করি, ২৬ এপ্রিল থেকে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার নিন্মমুখী। ২৬ এপ্রিলে আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৩৩০৬ জন আর মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৯৭ জন।
আক্রান্তের হার নিন্মমুখী হওয়া সত্ত্বেও বিপদ এখনও কেটে যায়নি। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে করোনার ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ নিয়ে ।
মারাত্মক রকমের প্রভাব বিস্তারকারী এই ভ্যারিয়েন্টের প্রতাপ দেখেছে ইন্ডিয়ার জনগণ যেখানে এখনও চলছে এর তাণ্ডবলীলা।
বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক (ডাঃ) এ. বি. এম খুরশিদ আলম নিশ্চিত করেছেন যে, বাংলাদেশে ১৯ জন করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছেন যাদের মাঝে করোনার ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব রয়েছে।
তাহলে বলা যেতে পারে, এখনও অনেক বড় বিপদের আশঙ্কা বিদ্যমান আছে বাংলার মাটিতে।
বলিছি না, ছড়িয়ে যাবে ইন্ডিয়ার মত করে। করোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যও টিকে নি। তবে সচেতনতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লকডাউন দিয়েই যে সচেতনার বহিঃপ্রকাশ করা উচিত সেই কথা বলছি না। তবে নিয়মিত মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যাবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্য দিয়েও সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ সম্ভবপর হতে পারে।
তবে সরকারের ঘোষিত কঠোর লকডাউনের পর বর্তমানের এই দুর্বল লকডাউন যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। তবে কঠোর লকডাউন এই দেশে সম্ভবপর নয়। এটাই বাস্তবতা। কিছুই করার নেই।
সরকারের দেশের জনগণের আর্থিক আর সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে লকডাউন শিথিল করতে হয়েছে।
এছাড়া কিছুই করার ছিলো না যদিও। এখন এই বাস্তবতাকে একটু নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব জনগণের উপরেও বর্তায় কিন্তু! তবে কোথায়ও যেন বিশাল এক ফারাক লক্ষ্য করা যায়। যেন লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মত ছুটছে এই সচেতনার খেলা।
আসুন তাহলে বর্তমানের ঢাকা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আপনি যদি বিকাল চারটায় মগবাজার থেকে কাওরান বাজারে যেতে চান তাহলে আপনাকে পরতে হতে পারে বিশাল এক যানজটে।
আবার মার্কেটে গেলে দেখবেন নারী পুরুষ নির্বিশেষে উৎসব পালনে প্রস্তুতির ঘনঘটা। মার্কেটে চলছে দরদাম। মহিলাদের হিড়িক পরছে বড় বড় শপিংমল গুলিতে।
শুধু যে মহিলারাই তা নয়, যেকোনো বয়সী মানুষদের আনাগোনায় মুখরিত মার্কেট কিংবা ফুটপাত চত্বর। আবার গ্রামে যাওয়ার জন্য ফেরিঘাট যেন নদীর কিনারায় আরেক জনসমুদ্রের অস্তিত্ব। চলছে আর চলতেও থাকবে।
তাহলে একটি জিনিস খেয়াল করুন। এখন কি শুধুই অর্থনীতির দোহাই দেয়া যেতে পারে। হ্যাঁ, ব্যবসায়ীদের কথা বাদ দিয়েই বলছি। তারা ব্যবসা করবে। এটা স্বাভাবিক।
তবে যারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ভিড় জমাচ্ছে দোকানগুলিতে তারা কি তাদের ঘরে না খাওয়া বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য যাচ্ছে সেখানে?
কীভাবে দেখবেন তাদের এই উৎসব উল্লাসের প্রস্তুতিকে? নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে সচেতনতার অভাব। তবে এর সাথে আরেকটি জিনিসও আছে হয়তো। তা হচ্ছে স্বার্থপরতা। সমাজে একে অপরের প্রতি সহানুভূতির অভাবও এর মাঝে হয়তো কাজ করতে পারে।
যেমন, আপনি যদি রাস্তায় দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন কাউকে যে কেন তিনি মাস্ক পরেন নি তাহলে উত্তরে আসবে করোনা গরীবদের হয় না( যদিও এই কথার ভিত্তি নিয়ে সংশয় আছে)।
আবার যদি এমন কাউকে ধরেন যিনি হয়তো দারিদ্রতার দৃশ্যরুপে পরেন নি, তার উত্তর এমন যে, যারা সচেতন তাদেরই করোনা বেশি হয় (এটিরও নেই কোন উপযুক্ত ভিত্তি)। কিংবা কেউ ইঙ্গিত দিবে তার সুস্বাস্থ্যদের দিকে!
এখন একটু খেয়াল করে দেখুন এই ভাব প্রকাশের দিকে। কোথায়ও কি স্বার্থপরতারতাকে ইঙ্গিত করে না এই মন্তব্যগুলি? এমনটি হতে পারতো না যে, আমাদের সচেতন হতে হবে শুধু নিজেদের জন্যই নয় বরং আমাদের প্রতিবেশীদের জন্যও। কারন আমার কাছ থেকে ছড়িয়ে পরা ভাইরাস ছড়াতে পারে আমার মা, ভাই কিংবা অন্য যে কেউর শরীরে। তবে কি আমার উচিৎ নয় কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা! তবে আমাদের বাস্তবতা ঠিক উল্টো।
মার্কেটে নিজ স্বার্থের জন্যই তো যাওয়া হচ্ছে। আনন্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তো বড় উদ্দেশ্য এখানে।
হয়তো কেউ কেউ আছেন পুরোপুরি উপেক্ষার কারনেই ঘুরছেন। তবে এই জিনিসগুলি হয়তো আসছে ভ্রাতৃত্ববোধ, একজন আরেকজনের প্রতি সামান্য ত্যাগ না স্বীকার করার অভাব থেকেই। তবে এটি যদি হয়ে থাকে কারন, এর দ্বারা প্রমাণ করে, আমাদের সমাজে স্বার্থ হচ্ছে সবচাইতে আগের একটি বিষয়। হা, মানুষ স্বার্থপর।
তবে সামান্য পরিমানে কম দেখালে হয়তো পুরো সমাজে একটি ভারসাম্য আসলেও আসতে পারতো। হয়তো একজন ব্যক্তি নিজেও জানেন না, যে ত্যাগ তিনি করছেন সমাজের জন্য সেটির উপকার হয়তো তিনি নিজেও পাচ্ছেন।
হয়তো এই ত্যাগই পার্থক্য সৃষ্টি করছে আমাদের আর উন্নত সমাজের মধ্যে। আমাদের এই বাংলাদেশের সমাজে স্বার্থপরতা এমন এক অবস্থায় চলে গিয়েছে যেখানে নিজের ক্ষতিসাধন করেও স্বার্থ নামক ভ্রান্তি ধরার প্রক্রিয়া চালাতে ব্যস্ত মানুষেরা। পরোপকার নেই বললেই চলে।
অর্থনৈতিক টার্ম জি. ডি. পি ব্যাবহার দিয়ে হয়তো একটি দেশের উন্নতি প্রকাশ পায় না, বরং সেই দেশের মানুষের প্রতি মানুষের ব্যাবহার দিয়েও প্রকাশ পেতে পারে সমাজ কতটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে। কনজিউমারিজম এর জগতে ঘাটতি মূল্যবোধের, নৈতিকতার।
তবে এটি বাস্তব যে আমরা যতটা শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যায় দুর্যোগের সময়। অনেকের মাঝেই হয়তো ভদ্রতা, নম্রতা দিয়ে নিজেকে সমাজের উচ্চস্তরে রাখার প্রচেষ্টার পিছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াল পশু। তা না হলে কি পাগলের মত বাজার ছাপাই করি করোনায় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার ভয়ে, অন্যের হতে পারে এই আশায় ঘুরে বেড়াই মার্কেটে মার্কেটে। সমাজের এই বৈচিত্র্যময় শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার খেলা টিকে থাকবে কতকাল সেটিই দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্রঃ