গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা হয় কেন

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যথা – কারণ ও ঘরোয়া প্রতিকার

গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা গর্ভাবস্থা নারীদের একটি সাধারণ সমস্যা

তবে এই ব্যথা কখনো কখনো চিন্তার কারণ হতে পারে, আবার কখনো তা স্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে ঘটে। তাই এর কারণ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা উচিত।

গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথার কারণ

তলপেটে ব্যথার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যা গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। নীচে প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. জরায়ু বৃদ্ধির কারণে ব্যথা

গর্ভাবস্থার সময় শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জরায়ুও ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে। এই বৃদ্ধির ফলে জরায়ুর চারপাশের পেশি, লিগামেন্ট, এবং টিস্যুগুলোর ওপর চাপ পড়ে। বিশেষত, জরায়ুর চারপাশের বাঁধন বা লিগামেন্টগুলো টান পড়ার কারণে তলপেটে হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বেশি দেখা যায়, যখন জরায়ু দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যদিও এটি স্বাভাবিক পরিবর্তনের অংশ, অনেক নারী এই সময়ে পেটের নিচের অংশে টান ধরা বা ব্যথা অনুভব করেন, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাময়িক এবং শারীরিক বিশ্রাম নিলে কমে যায়।

২. গ্যাস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য

গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীরে প্রজেস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা পেশি শিথিল করতে সাহায্য করে। এই হরমোনের প্রভাবে হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, যার ফলে গ্যাস জমে যায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। গ্যাস জমা বা হজমজনিত সমস্যার কারণে পেট ফুলে যেতে পারে এবং তলপেটে অস্বস্তি ও ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যও গর্ভাবস্থার সময় একটি সাধারণ সমস্যা, কারণ বড় হতে থাকা জরায়ু মলাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে স্বাভাবিকভাবে মল নির্গমন ব্যাহত হয়। গ্যাস এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে পেটের নিচের অংশে ব্যথা এবং অস্বস্তি অনুভূত হয়, যা প্রায়শই গর্ভবতী নারীদের বিরক্ত করে। এই সমস্যাগুলো কমানোর জন্য বেশি পানি পান করা, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা সহায়ক হতে পারে।

৩. লিগামেন্ট টান

গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হতে থাকে এবং এর সঙ্গে জরায়ুকে সঠিকভাবে স্থানে ধরে রাখার জন্য লিগামেন্টগুলো প্রসারিত হয়। এই প্রসারণ প্রক্রিয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে জরায়ুর চারপাশের লিগামেন্টগুলোতে টান পড়ে, যা তলপেটে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, ‘রাউন্ড লিগামেন্ট’ নামে পরিচিত জরায়ুর দুটি প্রধান লিগামেন্ট, যেগুলো জরায়ুকে পেলভিসের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে, গর্ভাবস্থার সময় দ্রুত প্রসারিত হয়। যখন হঠাৎ করে কোনো নড়াচড়া করা হয়, যেমন হাঁচি দেওয়া, কাশি করা, বা শরীর মোড়ানো, তখন এই লিগামেন্টগুলোতে দ্রুত টান পড়ে এবং তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত তলপেটের নিচের দিকে বা কোমরের দিকে অনুভূত হয়। যদিও এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক এবং ক্ষণস্থায়ী, তবে অনেক গর্ভবতী নারী এই সময়ে আরামদায়ক শারীরিক অবস্থানে থাকলে বা বিশ্রাম নিলে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

৪. প্রসবের সংকেত

গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে তলপেটে ব্যথা অনেক সময় প্রসবের সংকেত হিসেবে দেখা দেয়। এই ব্যথা সাধারণত অনিয়মিত হতে শুরু করে, তবে ধীরে ধীরে তা নিয়মিত এবং তীব্র হতে থাকে। প্রসবের সংকেতের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো প্রসবের ব্যথা, যা পেটের নিচের অংশ এবং পিঠে তীব্র টান ধরা বা চাপ অনুভব করায়। এই ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে এর তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়।

এছাড়াও, পানি ভেঙে যাওয়া (যা অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড নির্গত হওয়া) বা রক্তমিশ্রিত মিউকাস প্লাগ বের হয়ে আসাও প্রসবের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যথার সাথে কোমর, পিঠ এবং তলপেটে টান ধরা অনুভূত হয়, যা প্রসবের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা দেয়। যদি এই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি প্রকৃত প্রসবের সূচনা হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা উপশমে যা যা করতে পারেন

গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও, এই ব্যথা কমানোর জন্য কিছু সহজ উপায় আছে যা মায়েদের আরাম দিতে পারে। অনেক সময় হালকা ব্যথা ঘরোয়া উপায়ে উপশম করা যায়, তবে যদি ব্যথা গুরুতর হয়, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নীচে তলপেটে ব্যথা কমানোর জন্য কিছু কার্যকরী পরামর্শ দেওয়া হলো:

১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন

গর্ভাবস্থায় শরীরের ওপর চাপ কমানোর জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে যখন তলপেটে ব্যথা অনুভব করেন, তখন বিশ্রাম নেওয়া ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে। শুয়ে বিশ্রাম নিলে তলপেটের চাপ কমে যায়, যা আরাম দেয়।

২. নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন

হালকা হাঁটা বা প্রসারিত ব্যায়াম গর্ভাবস্থার সময় পেশি শক্তিশালী রাখতে সহায়ক। এটি তলপেটের ব্যথা কমাতে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। তবে ব্যায়াম করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, বিশেষ করে যদি আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

পানি কম পান করার ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাসের সমস্যা বাড়াতে পারে। এই সমস্যা গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করলে ব্যথা উপশমে সাহায্য হতে পারে।

৪. উষ্ণ সেঁক ব্যবহার করুন

তলপেটে হালকা উষ্ণ সেঁক দিলে পেশি শিথিল হয় এবং ব্যথা কমে। তবে গরম পানির বোতল বা তাপমাত্রা বেশি না হওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে, কারণ অত্যধিক তাপ গর্ভের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৫. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন

গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে হালকা, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয় এবং গ্যাসের কারণে সৃষ্ট ব্যথা উপশম হয়। চর্বিযুক্ত খাবার ও অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।

৬. পা উঁচু করে শোয়ান

তলপেটে চাপ কমানোর জন্য পা উঁচু করে শোয়ার অভ্যাস করা যেতে পারে। এর ফলে শরীরের নিচের অংশে রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে এবং তলপেটের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৭. মনোযোগ দিন শরীরের সংকেতে

গর্ভাবস্থায় শরীরের যে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা ব্যথাকে অবহেলা করা উচিত নয়। যদি তলপেটে ব্যথা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে তা গুরুতর সমস্যার সংকেত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

গর্ভাবস্থায় তলপেটে ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এটি উপশমের জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এই সময়ে আরাম পাওয়া সম্ভব।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে

গর্ভাবস্থার সময় কিছু তলপেটে ব্যথা স্বাভাবিক হলেও কিছু ক্ষেত্রে তা গুরুতর সমস্যার সংকেত হতে পারে। নিচের উপসর্গগুলো থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  • রক্তপাত
  • প্রচণ্ড ব্যথা বা ক্রমাগত ব্যথা
  • মাথা ঘোরা বা বমি ভাব
  • জ্বর

About Mahmud

Leave a Reply