শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন, তাঁর শাসনামল নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনার ঝড়ও উঠেছে। একদিকে তাঁর নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান প্রশংসিত, অন্যদিকে তাঁর শাসনামলকে বিরোধী দল ও সমালোচকরা একদলীয় শাসনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
১৫ বছরের শাসন: গণতন্ত্র নাকি একদলীয়তা?
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে শেখ হাসিনার সরকার ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন নির্বাচন জিতে আসছে। তবে এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে দেশ-বিদেশে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন, ভোট কারচুপি এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছে।
বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনকে বিতর্কিত বলা হয়, যেখানে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল ন্যূনতম বা প্রায় অনুপস্থিত। সমালোচকদের মতে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কৌশলে ব্যবহার করে ক্ষমতার চক্রে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুতর সংকটের মুখে পড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) নামে বিতর্কিত একটি আইন পাশ হয়, যা সমালোচকদের মতে সাংবাদিকতা, মুক্তচিন্তা এবং বিরোধী কণ্ঠ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আইনের অধীনে সাংবাদিক, ব্লগার, এবং মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশ ক্রমশ একটি পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। বিরোধী মতাদর্শের কর্মীদের নিপীড়ন, গুম, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বিরোধী দল ও গণতন্ত্রের সংকট
শেখ হাসিনার সময়ে বিরোধী দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) এবং এর নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি কঠোর অবস্থান দেখা গেছে। খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড প্রদান এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনাগুলো আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
একাধিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতি শেখ হাসিনার আওতায় কার্যত একটি একদলীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর জন্য কার্যকর রাজনৈতিক মঞ্চ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার অভিযোগ
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দমনমূলক নীতি গ্রহণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। বিরোধী শিবির এবং ইসলামপন্থী দলগুলোর মতে, এই অভিযানে বহু মানুষ নিহত হয়, যদিও সরকার সেই সংখ্যাকে খণ্ডন করে।
উন্নয়নের আড়ালে কর্তৃত্ববাদ
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলো তাঁর সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে প্রশংসিত। তবে সমালোচকরা মনে করেন, এই উন্নয়নের আড়ালে গণতন্ত্রের বিকাশ ও জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
উপসংহার
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন নিয়ে আলোচনা দু’টি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে। একদিকে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর শাসনকে অনেকেই একদলীয় কর্তৃত্ববাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। সময়ই বলে দেবে, শেখ হাসিনার এই শাসনকাল ইতিহাসে কেমন মূল্যায়ন পাবে।