বিবর্তনবাদ কি?
বিজ্ঞানের মতবাদ গুলোর মধ্যে বিবর্তনবাদ হচ্ছে এমন একটি যেটি সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারনা রয়েছে । যখন আমরা প্রাত্যাহিক জীবনে এই শব্দ টি শুনি আমরা ভাবি যে , কোন প্রাণী বা কিছু একটা পরিবর্তিত হচ্ছে,বিবর্তন হচ্ছে । জাদুঘরগুলোতে একটি সাধারন দৃশ্য হচ্ছে ছবিতে টানানো একটি বন মানুষ বাকা হয়ে হাটছে,সেটি আস্তে আস্তে পরের ফটোতে দেখা যাবে সোজা হয়ে যাচ্ছে,এই ভাবে এক সময় তাঁকে সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে বা হাটার ভঙ্গিতে দেখা যাবে । যদিও এধরনের কিছু একটাই ঘটেছে, কিছু প্রাণী সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে ।
কিন্তু প্রকৃতিতে এমন কোন প্রক্রিয়া চালু নেই, এমন কিছু নেই যে হঠাত করে বন মানুষেরা ঠিক করলো যে বাকা হয়ে হাটার থেকে সোজা হয়ে হাটা ভালো,আর তাই এভাবে সোজা হয়ে হাটার চেষ্টা করতে করতে একসময় বহু বছর তাঁদের পিঠ সোজা হয়ে গেছে । এটি ভুল ধারনা । বিবর্তন এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য শব্দটি হচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন । এটি দিয়ে যা বোঝায় যে ,যেমন যেকোন সমাজে আমরা দেখতে পাই যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ রয়েছে, কেউ লম্বা, কেউ খাট, কেউ ফর্সা আবার কেউ কালো । এই বিভেদ গুলোর কিছু কিছু হয়তো তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তবে এর কিছু কিছু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ । অনেক সময় প্রকৃতি এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট গুলোকে নির্বাচন করবে ।
উদাহরন সরূপ বলা যায় যেমন শিল্প বিপ্লবের আগে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের মথ পোকা ছিল । এদের কারও কারও ডানায় সাদা,কালো দাগ,কোন কোন প্রজাতির হয়তো তেমন কোন দাগই ছিলনা । বছরের পর বছর এই আলাদা বৈশিষ্টের তেমন কোন তাৎপর্যই ছিলনা ।
গাছের গুড়িতে বসে থাকা মথ গুলো হয়তো কারো নজরে আসবেনা ,কারন গুড়ী গুলো হয়তো দাগে ভরা । মথ গুলো এতে মিশে থাকতে পারতো । কিন্তু হঠাত শিল্প বিপ্লবের কারনে প্রচুর পরিমানে কয়লা পোড়ানো হয়,যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট ধোয়ায় গাছের গুড়ি গুলো কালো বা ধুসর হয়ে গেল । আগের তুলনায় তারা অনেকটা বেশী গাড় হয়ে যাবার কারণে মথের আবাস্থলে আসলো বিরাট এক পরিবর্তন ।
সাদা-কালো ফুটকিওয়ালা এই মথ গুলোদের কে পাখি ও অন্যান্য শিকারি প্রানিরা অনেকটা সহজেই দেখতে পাবে, অন্তত পক্ষে অপেক্ষাকৃত কম দাগযুক্ত বা দাগবিহীন মথ গুলো থেকে এদের দেখা পাওয়া সহজ হয়ে পড়বে । পাখিরা শিকার করবে সব প্রজাতিই কিন্তু দাগওয়ালা মথগুলো তাঁদের শিকার হবে অনেক বেশী পরিমাণে । আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে পরিণামে কি হবে, যদি এই মথ গুলো বংশবৃদ্ধি করার আগেই বা করার মৌসুমে এরা পাখিদের শিকার হয় তাহলে তাঁদের সংখ্যা উল্লেখ যোগ্য ভাবে কমে যাবে ।
অন্যদিকে দাগহীন মথগুলোর সংখ্যা বেড়ে যাবে প্রচুর পরিমাণে । এখানে কি ঘটলো ? যখন চারাশের পরিবেশ ধুসর বা কালো হয়ে পড়ে তখন কালো হয়ে যাওয়াটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হতে পারে, কিছু জেনারেশন পরে এই কালো মথ গুলো কে দেখে ভাবতে পারেন যে ,বাহ এই মথগুলোতো দারুন বুদ্ধিমান ! তারা সবাই কোন ভাবে ঠিক করেছে যে কালো রং এর মথে বিবর্তিত হবে !
কিন্তু এক্ষেত্রে তা ঘটেনি । যা ঘটেছে তা হল অন্যান্য রঙের মথ গুলো,বিশেষ করে পিপারড মথ গুলো পরিবেশের পরিবর্তনে অধিক পরিমাণে শিকার হয়েছে ফলে কালো মথগুলোর বংশবৃদ্ধি হয়েছে অনেক বেশী পরিমাণে । পারতপক্ষে সবচেয়ে ভাল উদাহরন হবে যেটি তা হল ফ্লু । ভাইরাস প্রকৃতপক্ষে একটি দারুন বিষয় কারন এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে তারা এমনকি জীবিত ।
আক্ষরিকভাবেই তারা হল প্রোটিন দারা আবৃত এক ঝাক ডি এন এ । এর বাইরে আর কিছুই নেই, তারা সচরাচর আমরা প্রাণী বলতে যা বুঝি সেরকম নয়,এরা সক্রিয়ভাবে নড়াচরা করেনা, বা এদের সক্রিয় কোন বিপাকপ্রক্রিয়া নেই । তবে তারা যা করে তা হল,যাদের বিপাকপ্রক্রিয়া আছে তাঁদের সংস্পর্শে আসার পরে এই ছোট ডি এন এ প্যাকেজটি এদের কোষের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় ।
তখন তারা এই ডি এন এ ব্যবহার করে আরও নতুন ভাইরাস তৈরির জন্য । ফ্ল’ও তৈরি হয় এক ধরনের ভাইরাসের কারণে। প্রতিবছরই এ ভাইরাসে বিভিন্ন বৈচিত্র তৈরি হয় । এগুলো যখন আমাদের শরীরে সংক্রমণ ঘটায় তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আস্তে আস্তে এদেরকে চিনে ফেলে এবং এরা ক্ষতি করে ফেলার আগেই ব্যবস্থা নেয় । ধরে নেই একটি ফ্লু ভাইরাসের দুটি দাগ আছে যেটি দেখে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একে চিনতে পারে, ধরে নেয় যে এটি শরীরের জন্য ভাল নয় এবং একে আক্রমন করে ।
ফ্লু ভাইরাসগুলো কে যদিও অনেকটা চতুর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কোন বুদ্ধিমান প্রাণী নয় তবে তাঁদের একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় । হয়তো দেখা যাবে এক ঝাকের ভেতরে দু একটা ভাইরাস থাকলো যাদের এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দাগ দুটোর পরিবর্তে একটি রয়েছে । এটি খুবই সাধারন একটি বিভেদ যা হয়তো থাকবে প্রতি মিলিয়নে একটা ।
কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন ঐ দুই দাগওয়ালা ভাইরাসটিকে আক্রমন করে দমন করা শুরু করবে, পরিনামে এই এক দাগযুক্ত বা তিন দাগযুক্ত কিছুটা অন্যরকম ভাইরাসটি কোষের সবকিছু পাবে তাঁদের নিজেদের জন্য যেহেতু তাঁদের সাথে প্রতিযোগিতা করার মত ভাইরাস নির্মূল হয়ে গেছে । ফলে তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারবে অধিক পরিমাণে । তাই নতুন বছরে এটি হয়ে উঠবে নতুন ফ্লু ভাইরাস ।
একই ঘটনা ঘটতে পারে অন্যান্য সংক্রমণের কারনে । যেমন আপনি হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া মাত্র সে আপনাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিল । তবে কোন দায়িত্ববান ভাল ডাক্তার তা করবেনা কারন নিতান্তই প্রয়োজন না হলে এই আন্টিবায়োটিক ব্যবহারে হীতে বিপরীত হতে পারে । কারন আপনি যত বেশী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবেন, ততই ব্যাক্টেরিয়ার নতুন সংস্করণ উদ্ভব হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । মনে করেন যে আপনার শরীরে একটি ব্যাক্টেরিয়ার প্রজাতি আছে যার অধিকাংশ সবুজ,এর মধ্যে কয়েকটি লাল বা নীল । এদের সংখ্যা বেশী বেড়ে গেলে আপনার শরীরে রোগ দেখা দিতে পারে,আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়তো এদের সংখ্যা কমিয়ে রাখতে সক্ষম ।
নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে যা ঘটে তা হল, আপনি হয়তো এমন একটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলেন যেটি সবুজ ব্যাক্টেরিয়াটি ধ্বংস করতে খুবই পারদর্শী । এখন যদি হঠাত করে সবুজ ব্যাক্টেরিয়া গুলো সব নির্মূল হয়ে যায় তাহলে বাস্তুসংস্থানে নীল বা লাল ব্যাক্টেরিয়ার সকল প্রতিযোগিরা সব শেষ হয়ে যাবার কারণে এরা তখন অধিক সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করবে, অথচ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্তা বা কোন অসুধ’ই তাঁদের কে খুজে নির্মূল করতে সক্ষম হবে না ।
ফলে আমাদের সামনে আবির্ভাব হবে এক সুপার ব্যাক্টেরিয়ার । তখন অ্যান্টিবায়োটিকটিও কোন কাজে লাগবেনা কারন এটিকে বিশেষভাবে বানানোই হয়েছিল সবুজ ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য । এটি বিবর্তনের ভাল একটি উদাহরন । নীল ব্যাক্টেরিয়াটি এমন ছিলনা যে এটি কোনভাবে নিজেকে তৈরি করেছে আলাদা ভাবে বরং পরিবর্তনটি এসেছে এলোমেলো ভাবে, কিছু বিচ্ছিন্ন পরিবর্তন যা অনুকূলে এসেছে নীল ব্যাক্টেরিয়াটির। একেই বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন ।