চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তা
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ,পরীক্ষা থেকে একটি স্ফুলিঙ্গ পরিণত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনায় । আজও শুধুমাত্র চেরনোবিল নামটিও সবার মনে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথাই মনে করিয়ে দেয় । চেরনোবিলের পারমাণবিক চুল্লীর সেই দুর্ঘটনার ত্রিশ বছর পরেও এখনো পর্যন্ত যে কথাটি অনিশ্চিত তা হল চেরনোবিল কি নিরাপদ বা ভবিষ্যতে কবে নিরাপদ হবে ?
চেরনোবিলে যা ঘটেছিল
উত্তর ইউক্রেন’এ অবস্থিত চেরনোবিল তদকালীন সোভিয়েত ইঊনিয়নেরই একটি অংশ ছিল । ১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর প্রকাশিত জার্নাল এর বলা হয় যে যে দুর্ঘটনার কারনে পুরো স্ক্যান্ডিনাভিয়া জুড়ে মারাত্মক তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে তার তীব্রতে ছিল তাৎক্ষণিকভাবে অস্পষ্ট ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আস্তে আস্তে বিস্তারিত জানা যায়, দুর্ঘটনাটি ঘটে পারমাণবিক চুল্লিটি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এর নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা পরীক্ষা করে দেখার সময় অপারেটর’দের ভুলের কারণে । পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য ছিল চুল্লীটিতে আকস্মিক ভাবে বিদ্যুৎ চলে গেলে তা কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায় বের করার জন্য ।
তারা চতুর্থ চুল্লীটিতে শীতলকারক পানি সরবরাহকারী ব্যাবস্থাটির সুইচ বন্ধ করে দেন যার ফলে চুল্লীর ভেতরে অবস্থিত পানি ফুটে বাইরে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে । পানি ঠান্ডা করার সকল প্রচেষ্টাই নিস্ফল হওয়ায় বাস্পে একটি বিস্ফোরন ঘটে যেটি ডমিনো এফেক্ট বা রিপল এফেক্ট তৈরী করে ।
তেজস্ক্রিয় ধোয়ায় আবহাওয়া মন্ডলে তৈরি হওয়া ভয়ানক বিষাক্ত মেঘে ছেয়ে যায় ইউরোপ ও পশ্চিম সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশ ।
এটীর তিব্রতা ছিল হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপণের পর পর যে তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি হয় তার থেকেও ৪০০ গুন বেশী ।
তাৎক্ষনিক মৃতদের সংখ্যা যদিও ছিল ৩১ – ৫৬ জন তবে হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জীবন হারায় ।
যদিও তেজস্ক্রিয়তা এত বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে তবে তা এখনো একটি বড় সমস্যা হিসেবেই আছে । ইউক্রেনিয়ান সরকার একমাত্র ট্যুর গাইডদের সাথে পর্যটকদেরকে এটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয় । ‘চেরনোবিল ট্যুর’ হছে তাঁদের মধ্যে একটি কোম্পানি যাদের কে চেরনোবিলের দুর্ঘটনা আক্রান্ত অংশের ১৮ মাইলের মধ্যে যেতে দেয়া হয় ।
তবে এক্ষেত্রে পর্যটকদের অবশ্যই তাঁদের বেধে দেয়া গাইড লাইন মেনে চলতে হয় একই সাথে প্রয়োজন হয় বিশেষ অনুমতির ।
এই গাইডলাইন অনুসারে শর্ট প্যান্ট বা ট্রাউসার পরা যাবেনা, এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশ বেড়িয়ে থাকে এমন কাপড় পরা যাবেনা , প্রকাশ্যে খোলা আবহাওয়ায় খাওয়া দাওয়া,পান করা বা ধূমপান করা যাবেনা একইসাথে মাটিতে বসা যাবেনা কিংবা বাড়িঘর হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবেনা ।
নিজেদের নিয়া আসা ক্যামেরা ,ব্যাগ বা কোন কিছুই সেখানকার মাটিতে রাখা যাবেনা । এই নিয়মগুলো আজব মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো করা হয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্যই । বিশেষকরে চতুর্থ চুল্লিটির কাছে উপযুক্ত পোশাক ছাড়া মাত্র দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই আপনি সংস্পর্শে আসবেন মরনঘাতি মাত্রা থেকেও ৭ গুন বেশী তীব্র তেজস্ক্রিয়তার । প্রশ্ন জাগে তাহলে এই ট্যুর কোম্পানিগুলো কেন এরকম জায়গাতে পর্যটকদের নিয়ে যায় ।
তাঁদের ভাষ্যমতে এখানে একটি দশ ঘন্টার ভ্রমনে পর্যটকরা বিমানে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া যাত্রিদের থেকেও কম তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসেন । সুকাচি, চেরনোবিলে অবস্থিত সবচেয়ে কাছের গ্রামটি চতুর্থ চুল্লীর ২৫ মাইলের মধ্যে অবস্থিত । বিশেষজ্ঞদের মতে চেরনোবিল মানুষের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ হতে সময় লাগবে কমপক্ষে ২০ হাজার বছর ।
যদিও সেখানকার মাটির কিছু কিছু অংশে এখনো উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে তবে মানুষের অনুপস্থিতিতে সেই জায়গা এখন হয়ে উঠেছে অসংখ্য প্রজাতির প্রানীর অভয় অরন্য । মানুষের বসবাসের জন্য অযোগ্যঘোষিত এ অঞ্চলটিতে বাস করে অসংখ্য নেকড়ে যাদের পশমেও রয়েছে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তা যা কোন ভাবে আপনার শরীরে প্রবেশ করলে আপনিও বিষক্রিয়ার সম্মুখীন হয়ে পরবেন । \
এসব প্রানীর অনেকাংশরই জন্ম হয়েছে এখানে এবং এদের সংখ্যায় বেড়ে যাবার একটি কারন হচ্ছে এদের শিকার ও বংশ নিধনের জন্য এখানে নেই কোন মানুষ ।
নেকড়েদের দলগুলো সবসময় এরকম নিরাপদ ছিল না । দুর্ঘটনার পূর্বে এদের পাল যেখানেই যেত সেখানেই সম্মুখীন হত নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের । এসময় বেছে বেছে শিকার করা হত ‘আলফা ফিমেল’ নেকড়েদের যা প্রভাবিত করে এদের পুরো বংশগতির ধারাকে ।
তবে শিকারই এদের প্রধান শত্রু ছিলনা ,এদের সংখ্যা বিলুপ্তির পথে যাবার প্রধান কারন ছিল চেরনোবিল কে ঘিরে শহরায়ন ও বনভুমি উজার । ১৯২০ সাল থেকে ১৯৮৬ এর চেরনোবিলের পারমাণবিক দুর্ঘটনার সময় পর্যন্ত এই নগরায়নের কেন্দ্রস্থল এ ভুমি হয়ে উঠেছিল পশুপাখির বসবাসের জন্য অনুপযোগী এক অঞ্চল, কিন্তু দুর্ঘটনার পরে আক্রান্ত অঞ্চলটিতে গড়ে ওঠে ঘন বনভূমির ।
ফিরে এসেছে বিভার নামের প্রানিটিও যেটি ছিল চাষাবাদের জন্য একটি হুমকিসরুপ, যে কারণে এদের কে নিধন করা হয় । তবে মানুষের অনুপস্থিতিতে এই অঞ্চলটিতে পুনরায় ফিরে এসেছে তারা । মানুষের আবাসস্থলগুলো ছেয়ে গেছে লতাপাতা আর সবুজ গাছপালায় । মানুষজনহীন গ্রাম গুলোর প্রতিটির প্রবেশস্থলে রয়েছে পাথরের ফলক যাতে লেখা রয়েছে গ্রামের নাম এবং জনসংখ্যা, এখন সেগুলোতে আবির্ভাব হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ।