শিশুর কাশি সাধারণত বিভিন্ন কারণের জন্য হতে পারে। শিশুরা তাদের ইমিউন সিস্টেম পুরোপুরি বিকাশ না করায় সহজেই বিভিন্ন ভাইরাস বা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। প্রচণ্ড কাশি হলে তা শিশুর এবং অভিভাবকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এই অবস্থায় কিভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া এবং কবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
কাশির কারণসমূহ
শিশুর কাশি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. শীতলতা বা ঠাণ্ডা লাগা
বাচ্চাদের শ্বাসযন্ত্র এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত না হওয়ায় ঠাণ্ডার সময় তাদের সহজেই কাশি হতে পারে। ভাইরাসজনিত শীতলতার কারণে শিশুর কাশি, নাক দিয়ে সর্দি পড়া এবং নিঃশ্বাসে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
২. ফুসফুসের সংক্রমণ (ব্রঙ্কিওলাইটিস)
এই বয়সে ব্রঙ্কিওলাইটিসও একটি সাধারণ সমস্যা। এই রোগটি ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হয় এবং এটি শিশুর শ্বাসনালির ক্ষুদ্র ব্রঙ্কিওল নামক নালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে প্রচণ্ড কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
৩. এলার্জি বা অ্যালার্জেনের প্রতি প্রতিক্রিয়া
শিশুরা ধুলাবালি, পরাগ, বা কোন নির্দিষ্ট রাসায়নিকের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে। এসব অ্যালার্জেনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কাশি এবং শ্বাসনালীর প্রদাহ হতে পারে।
৪. অ্যাসিড রিফ্লাক্স
অনেক সময় শিশুর অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা থাকলে তা কাশির কারণ হতে পারে। খাদ্যনালীতে অ্যাসিড চলে আসলে তা শ্বাসনালীতে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং এর ফলে শিশুর মধ্যে কাশির প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
৫. বাতাসের দূষণ
শিশুদের শ্বাসনালী খুব সংবেদনশীল হওয়ায় পরিবেশে ধোঁয়া, গ্যাস, বা অন্যান্য দূষণের কারণে তাদের কাশি হতে পারে। যেসব পরিবারে ধূমপান করা হয় বা যেসব এলাকা বেশি দূষিত, সেখানে শিশুরা বেশি কাশির সমস্যায় পড়ে।
বাচ্চার কাশি নির্ধারণের লক্ষণ
কিছু লক্ষণ রয়েছে যা দেখে বোঝা যায় বাচ্চার কাশি স্বাভাবিক নাকি চিকিৎসা জরুরি। এসব লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বাচ্চার জ্বর হলে এবং তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট (৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস) এর উপরে হলে।
- কাশির সাথে শ্বাসকষ্ট হলে বা বাচ্চার বুক ফুলে ওঠা-নামা করলে।
- কাশির সময় শিশুর মুখ নীলাভ হয়ে গেলে।
- বাচ্চা ঠিকমত খেতে না পারলে বা খাওয়ার সময় শ্বাস নিতে সমস্যা হলে।
- শিশুর কাশির শব্দ যদি হেঁচকি, গলা বসে যাওয়া, বা ফাটা ফাটা শব্দের মতো শোনায়।
- যদি কাশির সাথে রক্ত আসে।
কাশির জন্য প্রাথমিক করণীয়
শিশুর কাশি হলে নিচের কিছু পদক্ষেপ নিলে তা কমাতে সাহায্য করতে পারে:
১. শিশুর হাইড্রেশন বজায় রাখা
যেকোনো অসুস্থ অবস্থায় শরীরের আর্দ্রতা ঠিক রাখা খুব জরুরি। শিশুকে নিয়মিত দুধ খাওয়াতে হবে, বিশেষ করে বুকের দুধ। বুকের দুধ শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়ক।
২. গরম ভাপ দেওয়া
বাচ্চার নাক বন্ধ বা শ্বাস নিতে সমস্যা হলে তাকে একটি উষ্ণ ঘরে কয়েক মিনিট রেখে ভাপ দেওয়া যেতে পারে। গরম ভাপ শ্বাসনালীকে নরম করে এবং শ্লেষ্মা সহজে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে।
৩. শিশুকে সোজা রাখা
শিশুকে শোয়ানোর সময় মাথা একটু উঁচু করে রাখতে হবে। সোজা হয়ে বসিয়ে রাখা শিশুর শ্বাসনালির সমস্যা কিছুটা হ্রাস করতে পারে এবং শিশুকে আরাম দেয়।
৪. পরিবেশ পরিস্কার রাখা
বাচ্চার শোবার ঘর সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং ধুলাবালি, পোষা প্রাণীর লোম থেকে দূরে রাখতে হবে। ঘরে কোন প্রকার ধোঁয়া বা ধূমপানের ধোঁয়া যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পরেও যদি বাচ্চার কাশি অব্যাহত থাকে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, বা উপরের কোন গুরুতর লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বাচ্চাদের ওষুধ দেওয়ার আগে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহারে সতর্কতা
বাচ্চার কাশি হলে সাধারণত ওষুধ বা সিরাপ ব্যবহার করা হয় না, কারণ বাচ্চাদের দেহ এই বয়সে বিভিন্ন রাসায়নিকের প্রতি সংবেদনশীল থাকে। তবে, চিকিৎসক পরামর্শ দিলে কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক বা ইনহেলার দেওয়া হতে পারে।
১. কাশি সিরাপের ব্যবহার
শিশুর জন্য সাধারণত কাশি সিরাপ দেওয়া হয় না, কারণ তা ক্ষতিকারক হতে পারে। শুধুমাত্র চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ বা সিরাপ ব্যবহার করতে হবে।
২. ইনহেলার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা
কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হলে ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। এটি সাধারণত অ্যাজমা বা গুরুতর শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে ইনহেলার ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
কাশির প্রতিরোধের উপায়
শিশুর কাশি প্রতিরোধ করতে কিছু সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. শিশুকে ভিড় এড়িয়ে চলা
বাচ্চার ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় ভাইরাসের সংক্রমণ সহজেই হতে পারে। তাই যেসব স্থানে বেশি ভিড় বা অসুস্থ মানুষের উপস্থিতি রয়েছে, সেই স্থান থেকে বাচ্চাকে দূরে রাখা উচিত।
২. সঠিক টিকাদান
শিশুর জন্মের পর থেকে নিয়মিত টিকা দেওয়া হলে অনেক ধরনের সংক্রমণ থেকে শিশু রক্ষা পেতে পারে। টিকাদান শিশুদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করে।
৩. ঘর পরিষ্কার রাখা
শিশুর ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং যেকোনো ধরনের ধুলাবালি, ধোঁয়া, বা দূষণ থেকে তাকে রক্ষা করা উচিত। ঘরের পরিবেশ যত পরিষ্কার থাকবে, ততই শিশুর শ্বাসকষ্ট ও কাশির সমস্যা কমবে।
৪. শিশুর পোষাকের যত্ন
শিশুকে সব সময় আবহাওয়ার সাথে মানানসই পোশাক পরানো উচিত। ঠাণ্ডা লাগলে বা অতিরিক্ত গরমে শিশু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, তাই বাচ্চাকে আরামদায়ক পোশাক পরানো এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
বাচ্চার কাশি হলে তা তুচ্ছভাবে নেওয়া উচিত নয়। প্রাথমিক সতর্কতা ও ঘরোয়া চিকিৎসা নেওয়া হলেও যদি কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।